
নব্বই–এর পর বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির প্রধান প্রবণতা ছিল ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের শিক্ষার্থীদের ওপর কর্তৃত্ব কায়েম করা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর তারা নানা নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিয়েছিল। জোর করে মিছিলে অংশ নিতে বাধ্য করা, গেস্টরুমে ডেকে এনে গভীর রাত পর্যন্ত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালানো তখন প্রায় নিয়মিত ব্যাপার ছিল।
ছাত্ররাজনীতির নামে এক শ্রেণির শিক্ষার্থী নিজেদের সুপিরিয়র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা সরকারি দলের ভাড়াটে বাহিনী বা ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর দমন–পীড়ন চালাত।
ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতৃত্বের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এই সম্পর্ককে সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝানো যায় সামন্ত প্রভু–ভূমিদাস সম্পর্ক দিয়ে। বিগত বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ছাত্রনেতাদের প্রতি শিক্ষার্থীদের যেভাবে কুর্নিশ করতে দেখা গেছে, তা আসলে সেই সামাজিক সম্পর্কের প্রতিফলন। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত নিজের আত্মমর্যাদার সঙ্গে আপস করে চলতে হতো, তবেই কোনোভাবে টিকে থাকা সম্ভব ছিল।
একমাত্র সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের ব্যতিক্রম ছাড়া এই চিত্রে তেমন পরিবর্তন আসেনি। সরকার পরিবর্তনের আগে–পরে যারা হলে থেকেছেন, তারা জানেন, ক্ষমতা বদলের রাতে হলগুলোতে কীভাবে স্লোগান বদলে যেত। মজার বিষয় হলো, সামনের সারির কিছু মুখ পরিবর্তন হলেও নিপীড়নের কাঠামো একই থাকত। ফলে যৌন–সন্ত্রাস থেকে শুরু করে পিটিয়ে হত্যা পর্যন্ত সহিংসতা ক্যাম্পাসে অব্যাহত থাকত।
এই বাস্তবতায় গত ৩৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে বড় বড় আন্দোলন হয়েছে, তার সিংহভাগই ছিল নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন।
জাহাঙ্গীরনগরে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শামসুন নাহার হলে গভীর রাতে পুলিশি নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সেনাসদস্য কর্তৃক শিক্ষার্থী নিপীড়নের পর জরুরি শাসনবিরোধী আন্দোলন, এফ রহমান হলে আবু বকর নিহত হওয়ার ঘটনার পর ছাত্র আন্দোলনসহ অসংখ্য প্রতিবাদ হয়েছে, যেগুলোর প্রকৃতি মূলত নিপীড়ন থেকে মুক্তির দাবি ঘিরেই দাঁড়িয়েছিল।
এই সময়ে যে–ই ক্ষমতায় এসেছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণমঞ্চে পরিণত করেছে। দীর্ঘ নয় বছরের সংগ্রামে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তার উল্টো চিত্র দেখা গেছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে ছাত্রদের গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।
এর কারণ সুস্পষ্ট। সাতচল্লিশ থেকে নব্বই পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো পরিকল্পিতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ, এই দেশের ছাত্ররা স্বভাবতই ক্ষমতাবিরোধী। তাই ছাত্র আন্দোলন বারবার জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে।
নব্বই–এর পরে একদিকে ছাত্রদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ বন্ধ করা হয়েছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন দিয়ে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছাত্ররাজনীতি থেকে শুরু করে শিক্ষক ও কর্মচারী রাজনীতি—সবখানেই রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে ঝাড়ুদার, মালি, দারোয়ান পর্যন্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া নির্ভর করেছে রাজনৈতিক পরিচয়ের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের বদলে ভোটার নিয়োগ হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এই রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দমবন্ধ পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ নেই।
শিক্ষার্থীদের এখন ভাবতে হবে তারা নিজেদের কী ভূমিকায় দেখতে চায়। ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়নি, চব্বিশের অভ্যুত্থানই তার প্রমাণ। তবে ছাত্ররাজনীতি কিংবা শিক্ষক রাজনীতির ধরন কেমন হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।
দুই.
যাঁরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনীতির গ্লাডিয়েটর খেলার মঞ্চে পরিণত করছেন, তাঁদের সন্তানেরা আর এখানে পড়াশোনা করে না। রাজনীতি ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকদের সন্তানরা এখন বিদেশে পড়াশোনা করে। ভোটের সময় দেশে ফিরে এসে বাবা বা দাদার কোটায় এমপি–মন্ত্রী হয়।
একসময় শহুরে ও বুদ্ধিবৃত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির সন্তানরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও নব্বই–এর পর থেকে তাদের সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় নেই বললেই চলে। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানেই সন্ত্রাস, সেশনজট আর দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি—এমন ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এর বিকল্প খুঁজতে বুদ্ধিবৃত্তিক মধ্যবিত্তরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা বিদেশমুখী হয়েছে। ফলে সেক্যুলারিজম, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, উদারতাবাদ, বিশ্বজনীনতাবাদ—এসব মূল্যবোধ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকটাই হারিয়ে গেছে।
তার জায়গায় গত দুই দশকে নতুন উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষার্থীরাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছে। আর সেখানে ক্রমে পরিচয়ভিত্তিক সংস্কৃতি প্রাধান্য পাচ্ছে।
তিন.
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণার বদলে কেন রাজনীতি প্রাধান্য পেল, তার সূত্র বোঝার জন্য অভিজাত শ্রেণির দিকে তাকানো দরকার। উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সময়ে ছাত্র আন্দোলনের ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। সামরিক শাসন থেকে মুক্তির ক্ষেত্রেও ছাত্র আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পাকিস্তানি উপনিবেশিক সময় আর বাংলাদেশের সামরিক স্বৈরাচারী সময়ে ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে।
কিন্তু যেসব দেশ পরবর্তীতে সামাজিক স্থিতিশীলতা আনতে পেরেছে, তারা শিক্ষাকে রাজনৈতিকভাবে নয়, সামাজিক বিনিয়োগ হিসেবে দেখেছে। ফলে তারা তার সুফল পেয়েছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো তার উদাহরণ। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো নাগরিকদের বিভক্ত করে শাসন চালাচ্ছে। ক্ষমতায় থাকা দল ভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে দমনের চেষ্টা চালিয়েছে।
চার.
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রত্যাশিত হলেও সেটি নতুন প্রশ্ন সামনে এনেছে। শিক্ষার্থীরা কি লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থেকে সত্যিই মুক্তি পাবে? ডাকসু নির্বাচনের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে জামায়াত ও বিএনপির নেতা–কর্মীদের অবস্থান দেখেই বোঝা গেছে, অভ্যুত্থান রাজনৈতিক দলগুলোর কাঠামোগত ভাবনায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।
ডাকসু–জাকসু নির্বাচন ছিল প্রথাগত রাজনীতির কাছে কৌশলের রাজনীতির পরাজয়। অভিযোগ আছে, অভ্যুত্থানের পর ছাত্রশিবির বিভিন্ন নামে ক্যাম্পাসে সক্রিয় হয়েছে এবং অন্য সংগঠনের কার্যক্রমে বাধা দিয়েছে। ছাত্রলীগের আমলে অনেকে গুপ্তভাবে রাজনীতি করলেও অভ্যুত্থানের পর তারা প্রকাশ্যে আসে।
হলে হলে গরিব শিক্ষার্থীদের সহায়তা দেওয়া থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের ক্লাব, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে শিবির–সমর্থিত শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দেখা গেছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিপুল অর্থ ব্যয়ে প্রচারণা চালানো হয়েছে। প্রশাসনে থাকা দলীয় শিক্ষকদের কাছ থেকেও তারা সুবিধা পেয়েছে। ফলে অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই শিবিরের হাতে চলে গেছে।
অনেক শিক্ষার্থী লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির বিরোধিতা করলেও তাদের সামনে নতুন কোনো বিকল্প রাজনীতি ছিল না। ছাত্রদল বা বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংগঠন কেউই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করতে পারেনি। বামপন্থিদের মধ্যে কিছু নেতা উৎসাহ জাগালেও সংগঠনগত বিভাজন আর প্রথাগত চিন্তার কারণে তারা শক্তিশালী বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি।
অতএব ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে পুরোনো ধারার লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিই আবার ফিরে এসেছে। গুপ্ত হোক বা প্রকাশ্য, লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি শেষ পর্যন্ত নিপীড়নমূলক হয়ে ওঠেই। কারণ ছাত্ররাজনীতিকে জাতীয় রাজনীতির গ্লাডিয়েটর খেলার মঞ্চে ব্যবহার করা হবে না—এমন অঙ্গীকার কোনো রাজনৈতিক দলই দেয়নি।
শিক্ষার্থীদেরও তাই ভাবতে হবে, তারা নিজেদের কোন ভূমিকায় দেখতে চায়। ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়নি, চব্বিশের অভ্যুত্থানই তার প্রমাণ। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতির ধরন কেমন হবে, তা নিয়ে ভাবার সময় এখনই।
আমেরিকা বাংলা | আমেরিকার বাংলা খবর, কমিউনিটি ও বিশ্ব সংবাদ আমেরিকায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য সর্বশেষ বাংলা খবর, কমিউনিটি সংবাদ ও বিশ্ব আপডেট।