ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা এতটাই বেড়েছে যে এখন নতুন করে পানি তোলা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এই সংকট কাটাতে ২০১৪ সালে ঢাকা ওয়াসা শুরু করে ‘ঢাকা পরিবেশবান্ধব টেকসই পানি সরবরাহ’ প্রকল্প। মেঘনা নদী থেকে পানি এনে নারায়ণগঞ্জের গন্ধর্বপুরে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার সক্ষমতার একটি আধুনিক শোধনাগার নির্মাণ এবং রাজধানীতে ২৪ ঘণ্টা নিরাপদ পানি সরবরাহই ছিল প্রকল্পের লক্ষ্য। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৫ বছরের মধ্যে (২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে) ৫ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু বাস্তবে এক দশক পার হলেও প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি। ইতোমধ্যে তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এবং ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৭৩ কোটিতে।
ব্যয় বৃদ্ধির কারণ
ওয়াসার দাবি, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার উন্নয়নকাজের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা এবং ইউটিলিটি স্থানান্তরের জটিলতায় ব্যয় বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মেট্রোরেল, রাজউক, ডেসকো, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগসহ একাধিক সংস্থার কাজের কারণে পাইপলাইনের রুট পরিবর্তন ও নকশা সংশোধনে ৭০৬ কোটি টাকার অতিরিক্ত খরচ হয়েছে।
এ ছাড়া—
-
ডলারের বিনিময় হার ৮৪ টাকা থেকে ১২০ টাকায় ওঠায় খরচ বেড়েছে প্রায় ১,২০০ কোটি টাকা।
-
আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি চুক্তির শর্তে বিলম্ব সুদ ও প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্টে বেড়েছে আরও ৪২৩ কোটি টাকা।
-
ভ্যাট, শুল্ক ও কর বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত ৩৭০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
-
প্রশাসনিক জটিলতা, জমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা ও অনুমতি পেতে বিলম্বের ফলে প্রকল্পের কাজ বারবার থেমে গেছে।
প্রকল্প বাস্তবতার চিত্র
এখন পর্যন্ত প্রায় ৮৯ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হলেও পূর্ণ সুফল পেতে আরও অন্তত দুই বছর লাগবে। অথচ প্রতিশ্রুত ছিল, পাঁচ বছর আগেই ঢাকার বিশাল জনগোষ্ঠী নিরাপদ পানি পাবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা ৭০ শতাংশ থেকে কমে আসবে ৩৫ শতাংশে। প্রকল্প সময়মতো শেষ হলে মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলার চাপ অনেক আগেই কমানো যেত।
কিন্তু বিলম্বের কারণে—
-
প্রকল্পের অর্থনৈতিক লাভ প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে।
-
সরকারের ঋণ পরিশোধের চাপ বহুগুণ বেড়েছে।
-
সবচেয়ে বেশি ভুগছে ঢাকার সাধারণ মানুষ; মিরপুর, উত্তরা, মতিঝিল, বাড্ডা ও গুলশানের মতো এলাকাগুলোতে পানি সংকট আগের মতোই রয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মত
অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পের মূল সমস্যা ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে দুর্বল পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাব। জমি অধিগ্রহণ, অনুমতি ও ইউটিলিটি সমন্বয় শুরুতেই সম্পন্ন করা হলে এতটা বিলম্ব ও অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রয়োজন হতো না। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার কোনো পরিকল্পনা না থাকায় প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, এক দশক ধরে ঝুলে থাকা এই প্রকল্প এখন সরকারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সক্ষমতার ব্যর্থতার প্রতীক। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের অব্যবস্থাপনা শুধু করদাতাদের অর্থ অপচয় করে না, ভবিষ্যতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে এবং উন্নয়ন সহযোগীদের আস্থা কমিয়ে দেয়।