কূটনীতিতে নতুন ভৌগোলিক বিভাজন

নতুন সফরসূচি চূড়ান্ত হয়েছে। ২৩ আগস্ট পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকায় আসবেন। দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তিনি দুদিনের এই দ্বিপক্ষীয় সফর করছেন। এটি গত ৩০ বছরে পাকিস্তানের প্রথম কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক সফর।

সফরের সময়ে বাণিজ্য, হালাল ফুড প্রসেসিং, কানেকটিভিটি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। পাশাপাশি কৃষি, প্রতিরক্ষা, খাদ্য ও যোগাযোগের মতো খাতে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়েও আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে সার্কসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ। তবে এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে এই সফরের ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত তাৎপর্য।

গত সরকারে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক বেশ নিম্নমুখী ছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর ঢাকার স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির কারণে ভারত নিয়ন্ত্রিত পররাষ্ট্রনীতির বাইরে এসে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মোড় নিয়েছে। ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক এখন অস্থির, যা বাংলাদেশ-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতাকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে।

ইসহাক দারের এই সফর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হওয়ার প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে। বহু বছর পর আবার দুদেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক সংলাপ শুরু হতে যাচ্ছে। ২৭ ও ২৮ এপ্রিল হওয়ার কথা ছিল সফরটি, কিন্তু ভারতের কাশ্মীর পেহেলগাম হামলার পর উত্তেজনার কারণে তা স্থগিত হয়। নতুন আলোচনার মাধ্যমে সফরসূচি চূড়ান্ত করা হয়েছে।

২৩ আগস্ট একটি বিশেষ বিমানে ইসহাক দার ঢাকায় পৌঁছবেন। ২৪ আগস্ট রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনাও রয়েছে।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দুদেশের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্কের জন্য কাজ চলছে। দ্বিপক্ষীয় সকল ইস্যুতে আলোচনা হবে, ৭১ সালের বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে, তবে একটির জন্য অন্যসব ইস্যু আটকে থাকবে না। তিনি বলেন, ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান; ভারত নয়।

ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক এবং ইসহাক দারের সফর নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রচার শুরু হয়েছে, যেখানে সামরিক সহযোগিতা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সাবেক কূটনীতিকরা এই প্রচারকে সমর্থন করলেও ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের নতুন সংলাপকে দুই দেশের স্বার্থে প্রয়োজনীয় মনে করছে পাকিস্তান।

পাকিস্তানের গণমাধ্যম ‘ডন’ এক সম্পাদকীয়তে পরামর্শ দিয়েছে যে ১৯৭১-এর মতো স্পর্শকাতর ইস্যুগুলো এড়িয়ে না গিয়ে সামনে রেখে আলোচনা করা উচিত।

এক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলেছেন, ইসহাক দার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মকর্তা, যার সফর রাজনৈতিক দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক নতুনভাবে এগোচ্ছে এবং শীর্ষ নেতারা সম্পর্ক জোরদারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সফরের আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরোপিত ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে, পাকিস্তান থেকে পণ্যবাহী জাহাজ এসেছে, দুটি বেসরকারি বিমান সংস্থাকে সরাসরি বাংলাদেশে ফ্লাইট চালানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং সামরিক ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ শুরু হয়েছে।

২০১২ সালের পর এটি প্রথম দফায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হতে যাচ্ছে। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে সামরিক ও আঞ্চলিক সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ঢাকা এসেছিলেন, কিন্তু এই ধরনের দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক সফর বহু বছর পর হচ্ছে।

অন্যান্য বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকরা এই সফরকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের নতুন সূচনার হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন, এ সফরের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সমাধান সম্ভব হবে।

বিশেষ করে ভারতের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক দৃঢ় করার প্রয়োজন রয়েছে বলে বিভিন্ন বিশ্লেষক উল্লেখ করেছেন। সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সামরিক সহযোগিতাও শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূতরা মনে করেন, গত কয়েক দশকে সম্পর্ক স্থবির ছিল, এখন নতুন ভিত্তিতে যোগাযোগ ও সহযোগিতার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লাখ পাকিস্তানি নাগরিক রয়েছেন, যারা দীর্ঘদিন তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্কের এই নতুন পদক্ষেপগুলোকে অনেক পাকিস্তানি বিশ্লেষক কৌশলগত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। লন্ডনের কিংস কলেজের সিনিয়র ফেলো আয়েশা সিদ্দিকা বলছেন, ভারতীয় আধিপত্য মোকাবিলায় দুই দেশ একসঙ্গে এগিয়ে আসছে।

সার্বিকভাবে, ইসহাক দারের এই সফরকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ নতুন অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

আরও দেখুন

বিএনপির চাঁদাবাজি ও সহিংসতার–অভিযোগ: কোথায় কী ঘটছে, দল কী বলছে!

ঢাকা । আগস্ট ২০২৫: সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির স্থানীয় নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *