কোন নদীটা আমাদের ‘জাতীয় নদী’ হবে?

বিশ্ব নদী দিবস
বিশ্ব নদী দিবস

প্রায় দুই হাজার বৈচিত্র্যময় নদীর দেশ বাংলাদেশ। এই দেশের মাটি গড়ে উঠেছে নদীর বয়ে আনা পলিতে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো—এ দেশে একটি জাতীয় নদীও নেই। জাতীয় ফুল, জাতীয় ফল, জাতীয় পাখি, জাতীয় পশু, জাতীয় উদ্যান, এমনকি জাতীয় খেলাও আছে, কিন্তু নদীর জন্য কোনো জাতীয় পরিচয় নেই। আজ বিশ্ব নদী দিবসে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে অন্তত একটি নদীকে ‘জাতীয় নদী’ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দেওয়া।

যদি দেশে একটি জাতীয় নদী থাকত, তবে সরকার বিশেষ যত্ন নিত। সেই নদী সুরক্ষার জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকত। বর্তমানে কোনো নদীই শঙ্কামুক্ত নয়। অথচ একটি নদীকে জাতীয় নদী হিসেবে ঘোষণা করা হলে সেটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ চেষ্টা হতো। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অন্য নদীগুলোকেও বাঁচানো যেত।

আজকের শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে নদীর উল্লেখ খুব কম। যদি একটি জাতীয় নদী থাকত, তবে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই অন্তত একটি নদীর জন্ম, প্রবাহ, বাধা ও সংকট সম্পর্কে জানতে পারত। তারা বুঝত নদীর জীবনচক্র, আর নাগরিক হিসেবে নদীর প্রতি দায়িত্ববোধও তৈরি হতো।

বাংলাদেশের উচ্চ আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছে। আদালতের নির্দেশেই গঠিত হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। অর্থাৎ আইনগতভাবে নদীর আলাদা মর্যাদা রয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক উপদেষ্টাই নদী সংরক্ষণে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তাই এখনই সময়—একটি নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণার।

নদীর স্বাস্থ্য রক্ষা এখন মৌলিক দাবি। নদীর সুস্থতা যাচাইয়ের জন্য স্বাস্থ্য কার্ড তৈরির পরিকল্পনাও চলছে। স্বাস্থ্য কার্ডে নদীর অবস্থা লেখা থাকবে, আর তার ভিত্তিতে তৈরি হবে চিকিৎসাপত্র। এই উদ্যোগকে ইতিবাচক বলা যায়। এর মাধ্যমে প্রতিটি নদীর সমস্যা আলাদা করে চিহ্নিত করা যাবে।

কোন নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা দরকার। ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও পরিবেশগত গুরুত্ব বিবেচনায় কয়েকটি নদীর নাম ইতিমধ্যে আলোচনায় এসেছে। ব্রহ্মপুত্র—যা দেশের মোট পানির ৬০ শতাংশ বহন করে আনে, মেঘনা—যেখানে অসংখ্য নদীর পানি মিলিত হয়েছে, কিংবা তিস্তা—যা দেশের অন্যতম সংকটাপন্ন নদী, এগুলো হতে পারে সম্ভাব্য জাতীয় নদী। একইভাবে চট্টগ্রামের হালদা, বা ঐতিহ্যবাহী যমুনেশ্বরী-করতোয়া নদীকেও বিবেচনায় আনা যায়।

বাংলাদেশে এখনো প্রায় দুই হাজার নদী ছড়িয়ে আছে। সরকারিভাবে ১ হাজার ৪১৫টি নদীর তালিকা করা হয়েছে। বাকি নদীগুলোকেও তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। এত নদী থাকার পরও একটি জাতীয় নদী না থাকা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।

আমাদের প্রতিটি নদী স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বহন করে। কোনোটি আন্তসীমান্ত নদী, কোনোটি শাখানদী বা উপনদী। কোনো নদীতে সারা বছর পানি থাকে, কোনো নদী মৌসুমি। কোনো নদী ভাঙনপ্রবণ, আবার কোনো নদীতে গড়ে ওঠে চর, যেখানে মানুষ বছরের পর বছর বসবাস করে। পাহাড়ি নদী, জোয়ারভাটার নদী কিংবা সুন্দরবনের নদীগুলোও ভিন্ন রূপে বয়ে চলে।

নদী শুধু ভৌগোলিক সত্তা নয়, আমাদের সংস্কৃতি, সাহিত্য আর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে ছোট নদী বৈশাখে হাঁটু জল নিয়ে চলত, সেই নদীগুলো আজ প্রায় শুকিয়ে গেছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনধারা ও অর্থনীতির সঙ্গে এত গভীরভাবে জড়িয়ে থাকা নদীর জন্য একটি জাতীয় পরিচয় দেওয়া তাই সময়ের দাবি।

অতএব, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে একটি কমিটি গঠন করে আলোচনা ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে অন্তত একটি নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা। এতে শুধু নদী রক্ষার পথ সুগম হবে না, বরং জাতি হিসেবে আমাদের নদীর প্রতি দায়বদ্ধতাও নতুন মাত্রা পাবে। বিশ্ব নদী দিবসে আমাদের প্রত্যাশা—বাংলাদেশ তার ‘জাতীয় নদী’ শূন্যতা পূরণ করবে।

আরও দেখুন

নাসা গ্রুপের শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পরিশোধে প্রশাসক নিয়োগ

নাসা গ্রুপের শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতনাদি পরিশোধের লক্ষ্যে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *