বাগরামে কী আছে, কেন এই বিমানঘাঁটি ফিরে পেতে চান ট্রাম্প

বাগরামে কী আছে, কেন এই বিমানঘাঁটি ফিরে পেতে চান ট্রাম্পপুরোনো একটা প্রবাদ আছে। ‘মধ্য এশিয়ার দখল যার, ইউরেশিয়ার কর্তৃত্ব তার।’

প্রবাদটির কথা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানেন কি না, কে জানে। তবে তাঁর কথার সূত্র ধরে প্রবাদটির প্রসঙ্গ নতুন করে সামনে এসেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প বারবার বলেছেন, আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ তাঁর দেশ ফিরে পেতে চায়।

বাগরাম নিয়ে ট্রাম্পকে অবশ্য আগেও কথা বলতে দেখা গেছে। তিনি তাঁর গত নির্বাচনী প্রচারের সময় দাবি করেছিলেন, বাগরাম চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) নিয়ন্ত্রণে আছে।

দ্বিতীয় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের তাঁর পরিকল্পনায় বাগরাম ঘাঁটি ওয়াশিংটনের নিয়ন্ত্রণে রেখে দেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল।

১৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বাগরাম প্রসঙ্গ তোলেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, চীনকে মোকাবিলার জন্য ঘাঁটিটি ফিরে পেতে চায় ওয়াশিংটন। তালেবানের সম্মতি নিয়েই ঘাঁটিটি নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

ট্রাম্প তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ২০ সেপ্টেম্বর লিখেছেন, বাগরাম ঘাঁটি যারা নির্মাণ করেছে, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যদি তা ফিরিয়ে না দেওয়া হয়, তাহলে খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের প্রশ্নে ট্রাম্প জানান, বাগরাম নিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্র। আর ঘাঁটিটি তাঁরা দ্রুতই ফিরে পেতে চান।

বাগরাম ফেরত পাওয়ার বিষয়ে ট্রাম্পের বক্তব্য আফগানিস্তানের তালেবান সরকার নাকচ করে দিয়েছে। তালেবান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিফ অব স্টাফ ফাসিহউদ্দিন ফিতরাত স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, আফগানিস্তানের এক ইঞ্চি মাটিও কারও কাছে হস্তান্তর সম্ভব নয়।

বাগরাম বিমানঘাঁটির অবস্থান আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে।

গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বাগরাম ঘাঁটি প্রথম নির্মাণ করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। আশির দশকে আফগান যুদ্ধের সময় আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনাদের প্রধান ঘাঁটি ছিল বাগরাম।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়। এই হামলার পর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে নামে যুক্তরাষ্ট্র। এই যুদ্ধের অংশ হিসেবে তারা আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে।

মার্কিন অভিযানে তালেবানের পতনের পর বাগরাম চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের দখলে। মার্কিন বাহিনী ঘাঁটিটি নতুন করে গড়ে তোলে। বাগরামকে এক সুবিশাল সামরিক কমপ্লেক্সে রূপ দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

আফগানিস্তানে টানা ২০ বছর যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারি চলে। এই সময়কালে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয় বাগরাম। বাগরাম সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন প্রেসিডেন্ট—জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প।

আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০২০ সালে তালেবানের সঙ্গে দোহা চুক্তি হয়। এই চুক্তির ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট নাগাদ আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা নির্ধারণ করেছিলেন ট্রাম্পের উত্তরসূরি জো বাইডেন।

তবে তালেবানের ত্বরিত অগ্রযাত্রার মুখে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তড়িঘড়ি করে আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয় মার্কিন বাহিনী। তখন থেকে বাগরাম ঘাঁটি আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের নিয়ন্ত্রণে।

বাগরামের সক্ষমতা

আফগানিস্তানের পারওয়ান প্রদেশে বাগরাম বিমানঘাঁটি অবস্থিত। বাগরাম সাধারণ কোনো বিমানঘাঁটি নয়।

৭৭ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত বাগরামে দুটি বিশাল রানওয়ে আছে। এর মধ্যে একটি রানওয়ে ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই রানওয়েতে বি-৫২ বোমারু বিমান ও বিশাল কার্গো বিমান সহজেই ওঠানামা করতে পারে।

এ প্রসঙ্গে ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, বাগরাম বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিমানঘাঁটি। বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘতম রানওয়ে আছে এখানে, যা ভারী কংক্রিট ও ইস্পাত দিয়ে তৈরি। রানওয়ের সক্ষমতা ও দৈর্ঘ্যের দিক থেকে বাগরাম বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী বিমানঘাঁটি। এই ঘাঁটিতে যেকোনো ধরনের বিমান ওঠানামা করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকাকালে ঘাঁটিটি ঘিরে বিশাল আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়, যা বিশ্বের অনেক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চেয়ে উন্নত ছিল। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের আসা-যাওয়ার প্রধান কেন্দ্র ছিল এই বাগরাম। এই বিমানঘাঁটি দিয়ে লাখো মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে আসা-যাওয়া করেছেন।ঘাঁটিটিতে ছিল জ্বালানি ডিপো, সুরক্ষিত আশ্রয়কেন্দ্র, কয়েক হাজার সেনার আবাসনের ব্যবস্থা, হাসপাতাল।

বাগরামে অত্যাধুনিক কমান্ড সেন্টার গড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এই কমান্ড কেন্দ্র ব্যবহার করেই আফগানিস্তানসহ পুরো অঞ্চলে সামরিক তৎপরতা, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা ও গোয়েন্দা কার্যক্রম চালিয়েছিল মার্কিন বাহিনী।

বাগরামে একটি কারাগারও স্থাপন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কারাগারটি আফগানিস্তানের ‘গুয়ানতানামো বে’ নামে কুখ্যাতি পেয়েছিল।

সব মিলিয়ে বাগরাম ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক মিশনের স্নায়ুকেন্দ্র।

এত গুরুত্ব কেন

কৌশলগত, সামরিক ও ভূরাজনৈতিক কারণে বাগরাম বিমানঘাঁটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আর এসব কারণেই যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তালেবানের কাছ থেকে এই ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে চান, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন বাগরাম দরকার, তার অন্তত একটি কারণ ট্রাম্প প্রকাশ্যে, স্পষ্টভাবে বলেছেন। চীন যেখানে (শিনজিয়াং) পরমাণু অস্ত্র তৈরি করে, সেখান থেকে বাগরাম মাত্র এক ঘণ্টার পথ।

ট্রাম্পের এই হিসাব নিখুঁত হোক বা না হোক, প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিস্তৃত নজরদারি সুবিধা কার্যকরভাবে দেওয়ার মতো জুতসই অবস্থানে আছে বাগরাম। মার্কিন কর্মকর্তারাও এ কথা সিএনএনের কাছে স্বীকার করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে বাগরাম এমন এক কৌশলগত স্থানে অবস্থিত; যা পুরো এশিয়ার ওপর নজরদারি সুবিধা দিতে সক্ষম। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রে আছে মধ্য এশিয়া। কারণ, যে শক্তি মধ্য এশিয়া নিয়ন্ত্রণ করবে, সে-ই ইউরেশিয়ায় সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে।

ইউরেশিয়া হলো ইউরোপ ও এশিয়া মিলিয়ে এক বিশাল ভূখণ্ড। মার্কিন কূটনীতিক জবিগনিউ ব্রেজিনস্কি ইউরেশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি ইউরেশিয়াকে একটি বিশাল দাবার ছকের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যেখানে বড় শক্তিগুলো (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত ইত্যাদি) নিজেদের কৌশল সাজায়। অর্থাৎ, ইউরেশিয়া হলো বিশ্ব শক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক খেলার কেন্দ্রীয় মঞ্চ।

ওয়াশিংটনের জন্য বাগরাম নিয়ন্ত্রণের মানে হবে ইউরেশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করা। পুরো অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত নজরদারি ও গোয়েন্দা কার্যক্রম সহজ হয়ে যাওয়া।

বাগরাম থেকে পূর্বে পাকিস্তান, উত্তরে চীন, দক্ষিণে ভারত—সবই হাতের নাগালে। আবার বাগরাম থেকে মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব ও ইরানের কার্যকলাপ নজরে রাখা সম্ভব।

বাগরাম যখন ওয়াশিংটনের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তখন মস্কো ও তেহরান উভয়ের কাছে ব্যাপারটি ছিল নিজেদের ‘অঙ্গনে’ এক অনাকাঙ্ক্ষিত শক্তির (পড়ুন শত্রু) উপস্থিতি।

যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বাগরাম ছিল তালেবান, আল–কায়েদা ও আইএসের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর মূল কেন্দ্র। বাগরাম হারানোর পর এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ নেওয়ার সক্ষমতা সংকুচিত হয়ে যায়।

দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাগরামকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম চালানোর বিষয়টি নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।

আফগানিস্তান মূল্যবান খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ। দেশটির খনিজ সম্পদের ওপর নজর আছে যুক্তরাষ্ট্রের। বাগরাম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এই সম্পদের ওপরেও কৌশলগত প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

আফগানিস্তান নতুন একাধিক বাণিজ্যিক করিডরের ওপর অবস্থান করছে। এই রুটগুলো ব্যবহার করতে চায় রাশিয়া ও চীন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বাগরাম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রুটগুলোয় কৌশলগত নজরদারি ও প্রভাব বিস্তার করতে চায়।

তালেবানের ঝটিকা অগ্রযাত্রার মুখে ২০২১ সালের জুলাইয়ের শুরুতে মার্কিন বাহিনী যেভাবে গোপনে বাগরাম ছেড়েছিল, সেটিকে তখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি অপমান হিসেবে দেখা হয়েছিল। ট্রাম্প এখন বাগরাম পুনরুদ্ধার করে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিমত্তার বার্তা দিতে চান। ট্রাম্প জানান দিতে চান, মধ্য এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটছে না।

আরও দেখুন

অ্যামেরিকা থেকে প্রায় ৪০০ ইরানিকে বিতাড়ন শুরু

অ্যামেরিকা থেকে কয়েক শত ইরানিকে বিতাড়ন শুরু করেছে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। অ্যামেরিকা ও …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *