তেমন হলে ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) জ্ঞানেশ কুমারকে ইমপিচড (অভিশংসিত) করার রাস্তায় হাঁটতে পারে বিরোধীরা। আজ সোমবার কোনো কোনো নেতার কাছ থেকে এই রকম ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
তা যদি হয়, তাহলে সেটা হবে সংসদীয় ভারতের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা। এর আগে কোনো সিইসির বিরুদ্ধে কখনো অভিশংসন প্রস্তাব আনা হয়নি।
বিহার রাজ্যের বিধানসভা ভোটের আগে ভোটার তালিকা সংশোধনে যে নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশন (ইসি) শুরু করেছে, বিরোধীদের কাছে তা বিজেপির হয়ে ইসির ‘ভোট চুরি’। এর বিরুদ্ধে গতকাল রোববার থেকে বিহারে ‘ভোট অধিকার যাত্রা’ শুরু করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ও আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদবসহ বিরোধী জোটের নেতারা।
রাহুল গান্ধী ‘তথ্যপ্রমাণ’ দাখিল করে প্রচার করেছেন, ইসি কীভাবে বিজেপির হয়ে ভোট চুরি করেছে কর্ণাটকে, মহারাষ্ট্রে, হরিয়ানায়। এভাবে ইসি বিহারেও ভোট চুরি করতে চাইছে বলে রাহুলের অভিযোগ। ইসি অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কোনো অভিযোগের তদন্তের নির্দেশ দেয়নি। বরং রাহুলকে ৭ দিনের সময় দিয়ে বলা হয়েছে, হয় তিনি শপথ নিয়ে হলফনামা জমা দিয়ে বলুন যা বলেছেন তা সত্য, নয়তো দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চান।
রাহুল দুটি শর্তের কোনোটিই করতে রাজি নন। তিনি বলেছেন, তথ্যসহকারে অভিযোগের প্রমাণ দিয়েছেন। সংসদ সদস্য হিসেবে শপথও তাঁর নেওয়া। অভিযোগ যে অসত্য, তা প্রমাণের দায় ইসির।
এই পরিস্থিতিতে বিরোধীরা বুঝে গেছেন, ইসি নমনীয় হবে না। তদন্তের কোনো দাবিই মানবে না। যেভাবে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) করা হচ্ছে, সেভাবেই তারা চলবে। সুপ্রিম কোর্ট বাধা না দিলে ওই কাজ তারা থামাবে না। বিহার মামলা সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন।
বিরোধীদের কারও কারও মনে তাই সিইসিকে অভিশংসিত করার ভাবনা খেলেছে। যেমন সোমবার রাজ্যসভার কংগ্রেস সদস্য সৈয়দ নাসির হুসেন গণমাধ্যম এএনআইকে বলেন, ‘আইন মোতাবেক যা কিছু করণীয়, সবই আমরা করব। ইমপিচ করা নিয়ে আমাদের মধ্যে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। কিন্তু প্রয়োজন হলে সে পথেও হাঁটা যায়।’
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিজেপির হয়ে ভোট চুরির অভিযোগ এনেছেন রাহুল গান্ধী। কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুর এক লোকসভা আসনের ভোটার তালিকা দাখিল করে তিনি দেখিয়েছেন, সাতটি বিধানসভা আসনের মধ্যে ছয়টিতে হেরেও একটি কেন্দ্রে বিজেপি কীভাবে এক লাখ ভোটে এগিয়ে থেকে লোকসভা আসনটি জিতেছে। যে যে প্রমাণ রাহুল দাখিল করেছেন, তার একটিও সত্য বলে মানেনি ইসি।
গতকাল রোববার দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলন করে সিইসি জ্ঞানেশ কুমার শুধু বলেছেন, কমিশন ভোটারদের পাশে আছে। তাঁরা কোনো ভেদাভেদ করেন না। কমিশনের কাঁধে বন্দুক রেখে বিরোধীরা রাজনীতি করছে।
অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে তিনি বলেন, হয় রাহুল শপথ নিয়ে অভিযোগনামা দায়ের করুন, নয়তো ক্ষমা চান। ভোট চুরির অভিযোগের মধ্য দিয়ে রাহুল সংবিধানকে অসম্মান করেছেন।
সিইসি যখন সংবাদ সম্মেলন করছেন, তার আগেই বিহারের সাসারাম থেকে রাহুল গান্ধী, তেজস্বী যাদব, সিপিআই (এমএল) নেতা দীপংকর ভট্টাচার্যরা ভোটার অধিকার যাত্রা শুরু করেছেন। ১৬ দিন ধরে এই যাত্রা চলবে। যাত্রা শুরুর আগে বিরোধীরা প্রত্যেকেই বিজেপির হয়ে ইসির দালালির অভিযোগ করেন।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, ইসি অনেক দিন ধরেই বিজেপির এজেন্ট হয়ে গেছে। রাহুল বলেন, ইসিকে দিয়ে কারচুপি করানো হবে বলেই আইন এনে বলা হয়েছে, কমিশনের সদস্যদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। আইন এনে ৪৫ দিন পর সিসিটিভি ফুটেজ নষ্ট করার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
গত বছর আইন করে বলা হয়েছে, ইসি সদস্যদের সরানোর একমাত্র উপায় তাঁদের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে অভিশংসন প্রস্তাব আনা। সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের এভাবেই অপসারণ করা যায়। রাজ্যসভায় ন্যায্য দাবি না মানায় একসময় বিরক্ত বিরোধীরা চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দাখিল করেছিল। ‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’ থাকায় ডেপুটি চেয়ারম্যান সেই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছিলেন। পরে অবশ্য শাসক দলের কোপে পড়ে ধনখড় পদত্যাগ করেন।
সিইসির বিরুদ্ধেও তেমন কোনো প্রস্তাব আনা যায় কি না, সেই বিষয়টি বিরোধীদের বিবেচনায় রয়েছে। এমন নয় যে অভিশংসন প্রস্তাব পেশ হলেই তা পাস হবে। কারণ, প্রয়োজনীয় দুই–তৃতীয়াংশ সমর্থন বিরোধীদের পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রবল। বিরোধীরাও তা জানে। তবু এই ভাবনার কারণ ইসির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী রাজনৈতিক আখ্যান তৈরি করা। জনমত গঠন করা। ইসিকে চাপে রাখা।
গতকাল রোববার সিইসি জ্ঞানেশ কুমার কমিশনের পক্ষে যা বলেছেন বিরোধীরা আজ সোমবার তা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, জ্ঞানেশ কুমার একটি দাবিরও জুতসই জবাব দেননি। তাঁর বক্তব্য অযৌক্তিক, অন্যায্য ও পক্ষাপাতপূর্ণ। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, ভোটার নয়, তিনি বিজেপির পক্ষ নিয়েছেন।
কংগ্রেস, তৃণমুল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে, সিপিআই, সিপিএমসহ বিভিন্ন দলের নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, উচিত ছিল প্রতিটি অভিযোগের তদন্তের নির্দেশ দেওয়া। কিন্তু তা না করে সিইসি মূল অভিযোগকারীকে শপথ নিয়ে হলফনামা দাখিল করতে বলছেন, নতুবা ক্ষমা চাইতে বলছেন।
বিরোধীরা বলেন, বোঝাই যাচ্ছে, জ্ঞানেশ কুমার কিছু লুকাতে চান। লুকাতে চান বলেই বিজেপিও সংসদে বিহারের এসআইআর নিয়ে আলোচনা করতে চায় না।