যে সামরিক বাহিনী আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিল্লির কাছে পলায়ন করেছেন। রাষ্ট্রবিনাশী সেই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে সামরিক বাহিনীও রক্ষা পায়নি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হবে, শেখ হাসিনা ও তার পিতা শেখ মুজিব উভয়েই সামরিক বাহিনীর প্রতি গভীর বিরাগ পোষণ করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের একজন সাংবাদিক বন্ধু অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ‘Bangladesh: A Legacy of Blood’ নামে একটি প্রসিদ্ধ বই লিখেছিলেন। এই বইতে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, বাকশালের পতন এবং চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা রয়েছে, যা বাংলাদেশে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। মাসকারেনহাস তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তান আমলের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কারণে শেখ মুজিব বাংলাদেশে কোনো শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়তে চাননি।

ব্যক্তিগত আলাপে মাসকারেনহাসকে শেখ মুজিব বলেছিলেন,
‘Sheikh Mujib told me in February that he was against a powerful military force—I don’t want to create another monster like the one we had in Pakistan.’
(ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ মুজিব আমাকে বলেছিলেন, তিনি কোনো শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিপক্ষে। তার ভাষ্য ছিল, ‘আমি পাকিস্তানের মতো একটি দানব সৃষ্টি করতে চাই না।’)

নিজ নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী রাখতে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান থেকে ফেরার পর ভারতের সহায়তায় বিতর্কিত রক্ষী বাহিনী গঠন করেছিলেন শেখ মুজিব। উল্লেখযোগ্য যে, ভারতের শাসকরাও বাংলাদেশে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়তে কখনো আগ্রহী ছিলেন না।

১৯৭৫ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হবার পর বাকশাল শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটে। এ সময় সেনাবাহিনীর প্রতি শেখ হাসিনার পারিবারিক বিরাগ আরও গভীর হয়। এর উপর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও স্বাধীনতার ঘোষক জেনারেল জিয়াউর রহমান, যিনি একজন জনপ্রিয় সেনাপ্রধান ছিলেন, তার প্রতি শেখ হাসিনার সেনাবিদ্বেষ আরো প্রজ্বলিত হয়।

শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের নেতারা এবং ভারতপন্থি বুদ্ধিজীবীরা সবসময় বিএনপিকে সেনাবাহিনীর এক ধরনের ‘ক্যান্টনমেন্ট দল’ হিসেবে অপমান করেছেন। ১৯৯১ সালে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালনকালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার কৃষ্ণন শ্রীনিবাসনের কাছে সামরিক বাহিনী সম্পর্কে তীব্র বিরূপ ও মিথ্যা মন্তব্য করে তাকেও অবাক করেছিলেন। ওই ভারতীয় সাবেক কূটনীতিক ‘The Jamdani Revolution’ বইতে লিখেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতের প্ররোচনায় সৃষ্ট চাকমা বিদ্রোহের প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা উল্টো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করেছিলেন, বলেছিলেন, চাকমা বিদ্রোহীরা নয়, বরং সেনাবাহিনীর সদস্যরাই পার্বত্য এলাকায় সহিংসতা চালাচ্ছে। এই বক্তব্য ছিল প্রকাশ্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা, অথচ আজ পর্যন্ত কোনো সরকার তাকে বিচারের আওতায় আনেনি। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তর থেকেও এ ধরনের দেশ ও সেনাবিরোধী মন্তব্যের প্রতিবাদ দেখা যায়নি।

২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর, ফেব্রুয়ারিতে শেখ হাসিনা ও সেনাপ্রধান জেনারেল মইন খোদ রাজধানীতে ঘটে যাওয়া বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেন। এরপর দুর্নীতিবাজ জেনারেল তারিক সিদ্দিকের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীকে পরিকল্পিতভাবে কলুষিত করা হয়, নীতিহীন অফিসারদের ব্যবহার করে নিজের ও দিল্লির স্বার্থ সাধন করা হয়।

শেখ হাসিনা তার নির্বাচিত সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির সুযোগ দিয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা করিয়েছে, খুনের মামলার আসামি বানিয়েছে। বিভিন্ন বাহিনীতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের প্রবেশ ঘটিয়েছে, সামরিক বাহিনীর আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে এবং দেশপ্রেমিক বাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে।

দীর্ঘকাল ধরে অবৈধ ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল হিসেবে তিনি সেনাবাহিনীকে এতটাই হীনমন্য করে তুলেছেন যে, দুর্নীতিপরায়ণ ও অদক্ষ জেনারেলরা সেনাবাহিনীর ‘চিফ’ হয়েছেন। এমনকি একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহার ভুয়া এনকাউন্টারে হত্যা এবং তার লাশে লাথি মেরে কক্সবাজারে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ প্রধান সেনাপ্রধানকে অবজ্ঞা দেখিয়েছেন, যা প্রমাণ করে হাসিনার আমলে পুলিশ প্রধান সেনাপ্রধানের থেকেও শক্তিশালী ছিলেন। এই সময়ে জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, দেশের ক্যান্টনমেন্টগুলো ভারতীয় গোয়েন্দাদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। সামরিক বাহিনীর প্রতি তার কোনো সম্মান অবশিষ্ট রাখেননি।

শেখ হাসিনার এই কর্মকাণ্ডের ফলে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জনগণের দূরত্ব ও ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে, যা স্বাধীনতার জন্য বিপজ্জনক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনী ছিল দেশের অন্যতম গর্ব। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালের এক স্মরণীয় দৃশ্য আজও চোখে ভাসে, যেখানে একটি ট্যাংকের ওপরে সেনাসদস্য ও জনতা কোলাকুলি করছিল, ফুল দিয়ে সম্মান জানাচ্ছিল। সেই সময় জনগণ বিশ্বাস করেছিল সেনাবাহিনী দেশ ও স্বাধীনতা রক্ষায় বীরত্ব প্রদর্শন করেছে।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি এরশাদকে সেনাপ্রধান নুরুদ্দীন খান জানালে সেনাবাহিনী গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে আছে, তখনও জনগণ দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে অভিবাদন জানিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে জেনারেল নাসিমের ভারতপন্থি ক্যু বিফল করার মাধ্যমে সেনাবাহিনী জনগণের শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ভারতের ইশারায় সেনাদের এক-এগারোর অভ্যুত্থানের পটভূমিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনগণের দূরত্ব তৈরি হয়। সেই সময়ের সরকারও ভারতের সঙ্গে যোগসাজশে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনতে ষড়যন্ত্র করেছিল। এরপর থেকে দেশের রাজনীতিতে ডিজিএফআইয়ের অপতৎপরতা শুরু হয় যা শেখ হাসিনার পতন পর্যন্ত চলতে থাকে। ব্যক্তিগত লোভ ও স্বার্থে অনেক সেনা কর্মকর্তা রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীকে অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন।

অন্যদিকে, শেখ হাসিনা সামরিক বাহিনীকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজে যুক্ত করে প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার নৈতিকতা নষ্ট করেছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সামরিক বাহিনী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে অবস্থান নিলেও দীর্ঘ ১৮ বছরের জুলুমের কারণে জনগণের সঙ্গে বাহিনীর সম্পর্ক এখনো পুনঃস্থাপন হয়নি, যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবার ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৯০ এবং ১৯৯৬ সালের মতো দেশপ্রেমিক ও নির্ভীক রূপে ফিরে আসবে।

অনেকে বলেন, বর্তমান সরকারের নির্দেশ ছাড়া সেনাবাহিনী কিছু করতে পারে না, এজন্য শেখ হাসিনার ১৭ বছরের শাসনে সেনাবাহিনী প্রতিবাদ করেনি। আমার যুক্তি, বৈধ সরকারের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। ২০১৪ সালের একদলীয় নির্বাচন পর শেখ হাসিনা বৈধ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, তাই তার নির্দেশ পালন বাধ্যতামূলক ছিল না। এছাড়া মানবতাবিরোধী আদেশ যেমন আয়নাঘর প্রতিষ্ঠার নির্দেশ আইনগতভাবেও বাধ্যতামূলক হতে পারে না। তাই এর দায় শেখ হাসিনা ও সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে। সর্বোপরি, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনী প্রধান পাহারাদার, যদি বৈধ সরকার বিদেশি আধিপত্য মেনে দেশের স্বার্থহানি করে, তবে তার নির্দেশ পালন বাধ্যতামূলক নয়।

শেখ হাসিনার শাসনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক শক্তি ও জনগণের শিক্ষা নেওয়া আবশ্যক। দেশের ভূগোল ও প্রতিবেশী দেশের আধিপত্যবাদের মুখে একতা অপরিহার্য। রাষ্ট্রের সুরক্ষায় সামরিক বাহিনী একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেনাবাহিনীর কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠলেও, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা বা প্রশ্নবিদ্ধ করা চলবে না। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে শক্তিশালী সেনাবাহিনী দেখতে চাননি। এমনকি স্বাধীনতার পর প্রস্তাব হয়েছিল বাংলাদেশে কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না, শুধুমাত্র পুলিশ থাকবে। ভারতের শাসকশ্রেণি আমাদের দেশকে নিরাপত্তার নামে ভুটানের মতো অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করতে চেয়েছিল।

ভারতপন্থি বুদ্ধিজীবীরাও বিভিন্ন সময় সামরিক বাহিনীর জন্য বাজেট নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছেন, যা আমি মনে করি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ হুমকি মোকাবিলায় দক্ষ ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী থাকা প্রয়োজন। তবে সেই সেনাবাহিনী যেন আর কখনো ফ্যাসিবাদী আমলে বিদেশি আধিপত্যের অনুগামী হয়ে দেশের জনগণের ওপর নির্যাতনের হাতিয়ার না হয়, তা নিশ্চিত করাও জরুরি।

আমার জানা মতে, অন্তর্বর্তী সরকার সেনাবাহিনী সংস্কারের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, যা হতাশাজনক। আগামী নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের হাতে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করার সময় নেই। আশা করি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নিয়ে সকল স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে সেনাবাহিনী সংস্কারের কাজ করবে। ইনশাআল্লাহ, দেশের দেশপ্রেমিক জনগণ ও সামরিক বাহিনী ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা ও অখণ্ডতার বিরুদ্ধে সব হুমকি সফলভাবে মোকাবিলা করবে।

আরও দেখুন

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: ব্যয় বেড়ে ২৯০০ কোটি টাকা

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলা খাতে মোট বরাদ্দ নির্ধারণ করেছে নির্বাচন কমিশন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *