এআই যুদ্ধের শুরু—ডিপসিক কতটা হবে সফল?

এআই প্রতিযোগিতায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে চীনের প্রতিষ্ঠান ডিপসিক—মাত্র ৯৫% কম খরচে ওপেনএআইয়ের জিপিটি-৪ও-এর সঙ্গে টেক্কা দিয়ে। মাত্র দুই বছর আগে চীনের জেজ্যাং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীদের হাত ধরে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

ডিপসিকের প্রধান নির্বাহী লিয়াং ওয়েনফেং সবসময় বলে আসছেন—তাদের লক্ষ্য কেবল আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স (AGI) তৈরি নয়; বরং এমন প্রোগ্রামিং ও অ্যালগরিদম গড়ে তোলা, যা শক্তিশালী হার্ডওয়্যার ও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচের ওপর নির্ভরশীল হবে না। প্রতিষ্ঠানের দাবি, তারা এখনই লাভজনক—যেখানে ওপেনএআই এখনও সে পর্যায়ে পৌঁছায়নি।

২০২4 সালের ডিসেম্বরে ডিপসিকের V3 মডেল পশ্চিমা এআই-এর সমকক্ষ প্রমাণিত হয়েছিল, প্রোগ্রামিং, ডেটা অ্যানালাইসিস, লেখালেখি ও জটিল অঙ্ক সমাধানে অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে থেকে। তার পরবর্তী সংস্করণ R1 মডেল প্রকাশ পায় ২০ জানুয়ারি, যা পরীক্ষা করে অনেক ব্যবহারকারী একে চ্যাটজিপিটির শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

প্রযুক্তিগত দিক থেকে, R1 মডেলটি চালানো হয়েছে Nvidia H800 এআই অ্যাকসেলারেটরে, যা ওপেনএআইয়ের H100-এর তুলনায় কম ক্ষমতাসম্পন্ন। খরচের দিকেও বিশাল পার্থক্য—ডিপসিক দাবি করেছে, তাদের মডেলের শেষ পর্যায়ের ট্রেনিং খরচ হয়েছে মাত্র ৫.৬ মিলিয়ন ডলার, যেখানে ওপেনএআইয়ের জন্য ব্যয় হয়েছিল ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ব্যবহারের খরচে পার্থক্য আরও বেশি: প্রতি ১০ লাখ টোকেনে ওপেনএআই যেখানে ১৫ ডলার নেয়, ডিপসিক নিচ্ছে মাত্র ২.১৯ ডলার। এতে বাণিজ্যিক গ্রাহকদের ওপেনএআই থেকে ডিপসিকে সরে আসার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

এই বিশাল খরচের ব্যবধান শেয়ারবাজারে তাত্ক্ষণিক প্রভাব ফেলে। বিনিয়োগকারীরা ধারণা করেন—ডিপসিকের সেবা পশ্চিমা এআই কোম্পানিগুলোর আয় কমিয়ে দেবে, ফলে তারা এনভিডিয়া, গুগল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট ও ওপেনএআইয়ের শেয়ার বিক্রি শুরু করেন। এর ফলে এক দিনে এনভিডিয়ার বাজারমূল্য কমে যায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক দিনে সর্বোচ্চ দরপতনের রেকর্ড।

ডিপসিকের আরেকটি আলোচিত পদক্ষেপ হলো তাদের এআই মডেলগুলো সম্পূর্ণ ওপেন সোর্স করে দেওয়া। এর মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রযুক্তি-অবিশ্বাস দূর করা এবং যে কেউ নিজের পিসিতে মডেল চালাতে পারবে—এমন সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে এআই খাতে গুগল, মেটা ও ওপেনএআইয়ের ‘একচেটিয়া আধিপত্য’ ভেঙে যেতে পারে।

তবে ডিপসিকের সাফল্য নিয়ে বিতর্কও কম নয়। স্কেল এআইয়ের প্রধান নির্বাহী আলেক্সান্ডার ওয়াং অভিযোগ করেছেন—শুধু H800 চিপ দিয়ে এত শক্তিশালী এআই তৈরি সম্ভব নয়; ডিপসিক হয়তো অবৈধভাবে ৫০ হাজার H100 চিপ আমদানি করেছে। আরও অভিযোগ, R1 মডেলের বড় অংশ ওপেনএআইয়ের GPT-O1 থেকে নকল করা হয়েছে, এবং তাদের SDK ব্যবহারের ফলে ওপেনএআই গ্রাহকরা সহজেই মাত্র এক লাইন কোড পরিবর্তন করে ডিপসিকে ব্যবহার করতে পারবে।

জনপ্রিয়তায় ডিপসিক এখন অ্যাপল ও গুগল অ্যাপস্টোরের শীর্ষে, তবে অতিরিক্ত ব্যবহারকারীর চাপে তাদের সার্ভার ব্যস্ত। সমালোচকরা বলছেন—ডিপসিকের এআই চীনা আইনের প্রতি আনুগত্যশীল, যা আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারীদের জন্য সংবেদনশীল হতে পারে। সাইবার নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে; নিরাপত্তা ত্রুটি ধরা পড়ার পর তা সমাধান করলেও ইতালিতে ইতোমধ্যেই ডিপসিক নিষিদ্ধ হয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্রেও নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনা রয়েছে।

সব বিতর্ক ও সমালোচনার মাঝেও একটি বিষয় স্পষ্ট—ডিপসিকের উত্থানের মাধ্যমে পূর্ব-পশ্চিম এআই প্রতিযোগিতা নতুন মাত্রা পেয়েছে, এবং এর পরিণতি বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতের জন্য গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।

আরও দেখুন

ভিটামিন ‘বি’ আবিষ্কারের গল্প

ভিটামিনের ইতিহাসে ‘বি’ গ্রুপের ভিটামিন আবিষ্কার একটি চমৎকার অধ্যায়। উনিশ শতকের শেষ দিকে বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *