ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচন, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর রাত। পুরো ক্যাম্পাসে তখন এক অন্যরকম আবহ—আলোর ঝলকানি, স্লোগানের ঢেউ, আর হাজারো শিক্ষার্থীর অস্থির অপেক্ষা। বাতাসে মিশে আছে উত্তেজনা, আশা, সঙ্গে অদৃশ্য ভয়। দীর্ঘদিনের আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাঠে নেমেছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। কিন্তু ফল ঘোষণা হতেই যেন মাটি কেঁপে উঠল।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে গঠিত যৌথ জোট ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টি জয় করে নেয়। ছাত্রদলের উপ-সভাপতি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান পান মাত্র ৫,৭০৮ ভোট, আর প্রতিদ্বন্দ্বী শাদিক কায়েম এগিয়ে যান ১৪,০৪২ ভোটে। এটা শুধু হার ছিল না -এটা ছিল এমন এক ঝড়, যা ছাত্রদলের ভিত কাঁপিয়ে দেয়।
গল্পের শুরুটা কিন্তু আরও আগে। জুলাই আন্দোলনের পর দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত ছিল ছাত্রদল। যখন তারা ফিরে আসার চেষ্টা করল, তখনও ছাত্রদের মনে রয়ে গিয়েছিল পুরনো ক্ষত। ক্ষমতায় থাকার সময়ের অহংকার, হল দখল, নির্যাতনের স্মৃতি তখনো ভোলেনি কেউ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ-ই অতীতের বোঝাই শেষমেষ ভোটে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। প্রফেসর মযিবুর রহমানের ভাষায়, “সাধারণ ছাত্ররা বিএনপি ও ছাত্রদলকে বিশ্বাস করতে পারেনি। তারা ভেবেছে, ছাত্রদল জিতলে আবারও বিএনপি অসৎ রাজনীতির হাতিয়ার পাবে।”
এই ভয় অদৃশ্য দেয়ালের মতো আলাদা করে দিয়েছে ভোটার আর ছাত্রদলকে।
তবে শুধু অতীত নয়—অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাও ছিল বড় কারণ। বয়সে অনেক বড় নেতারা তরুণ ছাত্রদের সঙ্গে সংযোগ গড়তে পারেনি। হল-স্তরে প্রচারের ঘাটতি, কোনো নতুন দৃষ্টিভঙ্গির অভাব—সব মিলিয়ে এক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। বিএনপির এক নেতা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) স্বীকার করেছেন, “আমরা একটা গতি তৈরি করেছিলাম, কিন্তু ডাকসুর এই হার সব ভেঙে দিয়েছে। কর্মীরা ভেঙে পড়েছে।”
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসও ছিল বড় ফাঁদ। তারা ভাবতেই পারেনি, জুলাই আন্দোলনের সময় শিবিরের গোপন সেলগুলো এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। জামায়াতের সংগঠিত সমর্থন, বিতর্কমুক্ত ভাবমূর্তি আর ছাত্রবান্ধব প্রতিশ্রুতির কারণে শিবির মাঠে বাজিমাত করেছে।
এখন গল্পটা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বিএনপির দিকে। প্রশ্ন হচ্ছে—এই হারটা কি শুধু ছাত্রদলের? নাকি পুরো বিএনপির জন্য এক সতর্কবার্তা? বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা বিএনপির সামনে আনা আয়না, যেখানে নিজেদের দুর্বলতা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
প্রফেসর আল মাসুদ হাসানুজ্জামান মন্তব্য করেছেন,
“ডাকসুর এই ফল জাতীয় নির্বাচনের চিন্তাভাবনা বদলে দেবে বিএনপির। জামায়াতের উত্থান মাথায় রেখেই কৌশল নতুনভাবে সাজাতে হবে।”
এর মানে হলো, বিএনপিকে সাংগঠনিক পুনর্গঠন করতে হবে—সহযোগী সংগঠনগুলো থেকে শুরু করে বুদ্ধিবৃত্তিক দল পর্যন্ত। স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য মানুষকে সামনে আনতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হলো—অহংকার ছেড়ে বিনয় শেখা, আর পুরনো ভুল মেনে নেওয়া।
শেষ অধ্যায়ে আসে আশার আলো।
এই হার হয়তো কষ্টদায়ক, কিন্তু এটিই বিএনপির নতুন শুরুর ডাক হতে পারে। ডাকসু হয়ে উঠেছে আয়না, যেখানে নিজেদের আসল চেহারা তারা দেখেছে। কৃষকের ছেলে শিখবে—গভীর শিকড় ছাড়া ফল ধরে না। শহুরে ছাত্র বুঝবে—রাজনীতিতে জয়ের আসল চাবি হলো বিনয়, নয় দম্ভ। আর পুরো জাতি পাবে শিক্ষা—গণতন্ত্রের পথ আরও মজবুত করতে হলে পুরনো ছক ভাঙতে হয়।
ডাকসুর রাত তাই শেষ হয় না হতাশায়।
বরং এক নতুন সকালের প্রতিশ্রুতিতে—যেখানে ছাত্রদের জয়, বিএনপির শিক্ষা আর দেশের ভবিষ্যৎ একসাথে মিলে যায় একটি উজ্জ্বল গল্পে।