আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ভোটাররা কী করবেন

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ভোটাররা কী করবেন
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ভোটাররা কী করবেন

প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশের পর নির্বাচন কমিশন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। এমনকি নির্বাচনের সময় কীভাবে মব–সন্ত্রাস ঠেকানো যাবে, সেই পথও বাতলে দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন। তিনি বলেছেন, ৩০০ আসনে মব সন্ত্রাস ভাগ হয়ে গেলে তাদের মোকাবিলা করা কঠিন হবে না।

কিন্তু একজন সাবেক দক্ষ আমলা হিসেবে তাঁর জানার কথা কোনো নির্বাচনে ৩০০ আসনে সন্ত্রাস হয় না। যেসব আসনে মারদাঙ্গা প্রার্থী থাকেন, আর যেসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা কম থাকে, সেখানে সন্ত্রাস হয়। নির্বাচন কমিশনকে তাই ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র বাছাই করলেই হবে না, ঝুঁকিপূর্ণ আসনও বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ ১৯৯১ সালে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি একটি উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসের কাছে হার মেনেছিলেন এবং সেই নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় রাজনীতির গতি–প্রকৃতি বদলে দিয়েছিল।

একইভাবে যে আওয়ামী লীগ আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, তারাই আবার পরবর্তী সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেই ব্যবস্থা বাতিল করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছিল। তত্ত্বাবধায়ক–ব্যবস্থা বাতিলের পর যে তিনটি নির্বাচন হয়েছিল, তাতে জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল।

সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে নাসির উদ্দীন কমিশন এর আগে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৭২ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব। এতে সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগে পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল করার কথা বলা হয়েছে, প্রার্থীর বিদেশে থাকা সম্পদের হিসাব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব প্রস্তাব প্রার্থীর জবাবদিহির আওতায় আনা ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করি।

তবে নির্বাচন কমিশন একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে ‘না’ ভোটের বিধান রাখার যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্থলে কারসাজির সুযোগ বাড়িয়ে দিতে পারে। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির ৪৯ জন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন। এসব আসনে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা থাকলে নির্বাচনের গুণগত কোনো ফারাক হতো কি? বরং জয়ী দল এ কথা বলার সুযোগ পেত যে তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত নয়। অতএব কোনো বিধান চালুর আগে এর পরিণামের কথাও কমিশনকে ভাবতে হবে। নির্বাচন কমিশন যদি ‘না’ ভোট চালু করতে চায়, সব আসনের জন্যই সেটি করতে হবে। এখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ব্যক্তিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।

সরকার নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। অন্যদিকে একটি মহল স্বৈরাচারের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কমিশন কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা আমরা জানি না। যদি আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যায়, তাহলে তাদের সমর্থক ভোটাররা কী করবেন?
নির্বাচন কমিশন জোটবদ্ধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক বহাল রাখার কথা বলেছে। এটা গণতান্ত্রিক রীতির সঙ্গে কতটা যায়, সেই প্রশ্নও উঠবে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে প্রতীকের বিষয়টি উন্মুক্ত ছিল। কেউ জোটের প্রতীকে, কেউ দলের প্রতীকে নির্বাচন করেছেন। ২০১৮ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরাও ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করেছেন (যেহেতু জামায়াতের নিবন্ধন স্থগিত ছিল)। দলীয় প্রতীক রাখা নিয়ে ছোট দলগুলো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তাদের আশঙ্কা, এতে বড় দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়বে এবং ছোট দলের প্রার্থীদের বাড়তি ঝামেলায় পড়তে হবে।

নির্বাচন কমিশনের যে প্রস্তাব সবচেয়ে বেশি আলোচিত, সেটি হলো পলাতক আসামিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা। আদালত কোনো ব্যক্তিকে পলাতক ঘোষণা করলে তাঁর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ থাকার কথা নয়। পলাতক আসামিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার প্রস্তাবটি ছিল মূলত নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের। সে সময়ে নির্বাচন কমিশন এই প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত করেছিল।

গত মার্চ মাসে তারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে লিখিতভাবে জানিয়েছিল, এমন বিধান অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। এরপর কেন নির্বাচন কমিশন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিল, সেই প্রশ্নের জবাবে কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে উভয় পক্ষের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে এটা করা হয়েছে। প্রশ্নটা সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির নয়, আইনের। সংবিধানবিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক পলাতক আসামিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার প্রস্তাব সমর্থন করে ন্যায্য প্রয়োগ নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। রাজনৈতিক দলের নেতারা আইনের অপব্যবহার না হওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন।

নির্বাচন কমিশন আরও যেসব সংশোধনী প্রস্তাব এনেছে, সেগুলোও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। যেমন লাভজনক প্রতিষ্ঠানে থাকা ব্যক্তিকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে না দেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি থেকে পদত্যাগ করা, মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেশে ও বিদেশে থাকা সম্পদের হিসাব দাখিল করা। কমিশন প্রস্তাব করেছে, রাজনৈতিক দল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান নিতে পারবে; কিন্তু ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে সেটি চেকের মাধ্যমে নিতে হবে। এতে প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও প্রার্থীর পাশাপাশি অনুদানদাতার আয়–ব্যয়েও স্বচ্ছতা আসবে ধারণা করি।

নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ নির্বাচনে ভোটারদের ‘প্রথম চোখ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সাড়ে ১২ কোটি ভোটারের কতজনকে তাঁরা হাজির করতে পারেন, তার ওপরই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করছে। সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে, ভোটারদের বাছাই করার সুযোগ ছিল না বলে বিগত তিনটি নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। এবার সেই বাছাইয়ের সুযোগ কতটা থাকবে?

অনেকে বলেছেন, নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে সব দলের অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই। ভোটাররা অংশ নিলেই হবে মানলাম; কিন্তু ভোটাররা যদি দেখেন প্রার্থী বাছাইয়ে সুযোগ সীমিত, তাহলে তাঁরা ভোটকেন্দ্রে যেতে বা ভোট দিতে উৎসাহী হবেন না।

সরকার নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। অন্যদিকে একটি মহল স্বৈরাচারের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কমিশন কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা আমরা জানি না। যদি আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যায়, তাহলে তাদের সমর্থক ভোটাররা কী করবেন?

নির্বাচন কমিশন আরপিওতে যত সংশোধনীই আনুক না কেন, গরিষ্ঠসংখ্যক ভোটারকে কেন্দ্রে আনাই তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

আরও দেখুন

বাগরামে কী আছে, কেন এই বিমানঘাঁটি ফিরে পেতে চান ট্রাম্প

বাগরামে কী আছে, কেন এই বিমানঘাঁটি ফিরে পেতে চান ট্রাম্প

পুরোনো একটা প্রবাদ আছে। ‘মধ্য এশিয়ার দখল যার, ইউরেশিয়ার কর্তৃত্ব তার।’ প্রবাদটির কথা মার্কিন প্রেসিডেন্ট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *