চিকেন নেক নিয়ে উত্তেজনা: বাংলাদেশের লালমনিরহাটে বায়ুসেনা ঘাঁটির পরিকল্পনায় ভারতের শঙ্কা

চিকেন নেক
চিকেন নেক

ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা লালমনিরহাটে একটি বায়ুসেনা ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা ভারতের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করেছে। এই ঘাঁটি ভারতের অত্যন্ত সংবেদনশীল শিলিগুড়ি করিডর বা ‘চিকেন নেক’ থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, যা নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেছে ।

ভৌগোলিক ও কৌশলগত গুরুত্ব

শিলিগুড়ি করিডর ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের (সেভেন সিস্টার্স) সংযোগ রক্ষাকারী একমাত্র স্থলপথ। এই করিডরটি প্রায় ২২ কিলোমিটার সংকীর্ণ একটি এলাকা জুড়ে অবস্থিত, যা ভূ-কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।এই করিডর ছাড়া ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় রাজ্যের সরাসরি সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।এই করিডরের তিন দিকেই রয়েছে আন্তর্জাতিক সীমানা – পূর্বে ভুটান, পশ্চিমে নেপাল এবং খুবই কাছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক ও ঘাঁটি নির্মাণ

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশে চীনা কর্মকর্তাদের আনাগোনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ।প্রতিবেদনগুলোতে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশের লালমনিরহাটে প্রস্তাবিত বায়ুসেনা ঘাঁটি নির্মাণে চীনের কারিগরি ও সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সহায়তা থাকতে পারে। এমনকি চীনা কর্মকর্তারা স্থানটি পরিদর্শনও করেছেন বলে জানা গেছে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিআইএ) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চীন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামরিক সুবিধা প্রতিষ্ঠার কথা বিবেচনা করছে, যদিও এ সংক্রান্ত কোনো বিস্তারিত বিবরণ দেয়নি ।এদিকে, চীন তার প্রতিরক্ষা খাতের সামর্থ্য বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। ২০২৫ সালেও দেশটি তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট ৭.২% বৃদ্ধি করেছে, যা গত বছরের সমান ।

ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি

এই পরিস্থিতিতে শিলিগুড়ি করিডরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী।ভারতীয় সেনাবাহিনী এই করিডর সুরক্ষার জন্য রাশিয়ান তৈরি ‘সারফেস টু এয়ার মিসাইল’ (এসএএম) ব্যবস্থা মোতায়েন।ভারতীয় সেনা সূত্রের দাবি, সম্প্রতি মেঘালয় থেকে জলপাইগুড়ি সীমান্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের দিক থেকে আধুনিক ড্রোন ব্যবহার করে নজরদারির খবর তাদের হাতে এসেছে । জলপাইগুড়ির জল্পেশ এলাকায় অস্থায়ী সেনা ছাউনি তৈরি করা হয়েছে এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা হয়েছে ।

বাংলাদেশের সামরিক শক্তি ও বৈশ্বিক সম্পর্ক

বাংলাদেশ তার সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে চলেছে । গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের ২০২৪ সালের সূচক অনুযায়ী, বিশ্বে সামরিক শক্তির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৭তম, যা আগের বছর ছিল ৪০তম ।

নৌবাহিনীর জন্য চীনে তৈরি দুটি সাবমেরিনসহ দেশটির কাছ থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, ফ্রিগেট ও কর্ভেট জাহাজ । তবে বাংলাদেশ সম্প্রতি তুরস্কসহ পশ্চিমা দেশ থেকেও অস্ত্র আমদানি শুরু করেছে ।

আঞ্চলিক ভারসাম্যে প্রভাব

বাংলাদেশ যে কোনো দেশের সাথে তার সার্বভৌম অধিকারের ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। তবে, লালমনিরহাটে বায়ুসেনা ঘাঁটির পরিকল্পনা এবং চীনের সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে একটি সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে।

বাংলাদেশ-ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও, ভারতের অত্যন্ত সংবেদনশীল অঞ্চলের এত কাছাকাছি কোনো সামরিক স্থাপনা, বিশেষত একটি তৃতীয় পক্ষের অংশগ্রহণে, ভারতের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ । বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে তার বৈদেশিক নীতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা এবং প্রতিবেশী ভারতের legitime নিরাপত্তা চিন্তাভাবনার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সাথে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করা । মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে চীনের সম্ভাব্য সামরিক উপস্থিতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা এই অঞ্চলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গভীর মনোযোগেরই প্রতিফলন ।

শিলিগুড়ি করিডর বা ‘চিকেন নেক’ নিয়ে সাম্প্রতিক এই উত্তেজনা বাংলাদেশ-ভারত-চীন এই ত্রিমুখী সম্পর্কের জটিলতাকে ফুটিয়ে তোলে। বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সকল পক্ষেরই সংবেদনশীল ও সতর্ক কূটনীতির প্রয়োজন হবে। ভবিষ্যৎ আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা অনেকটাই নির্ভর করবে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও স্বচ্ছতাভিত্তিক সহযোগিতার ওপর।

আরও দেখুন

নাসা গ্রুপের শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া পরিশোধে প্রশাসক নিয়োগ

নাসা গ্রুপের শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতনাদি পরিশোধের লক্ষ্যে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *