প্রতিবাদ জানাতে ডিম ছোড়া হয় কেন? রয়েছে বিশাল ইতিহাস

ডিমের আঘাত: রাজনৈতিক প্রতিবাদের পুরোনো অস্ত্র আবারও আলোচনায়
ডিমের আঘাত: রাজনৈতিক প্রতিবাদের পুরোনো অস্ত্র আবারও আলোচনায়

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ডিম, টমেটো ও পানির বোতল নিক্ষেপের ঘটনা নতুন নয়। হাঁস বা মুরগির ডিম খাওয়ার টেবিলের একটি সাধারণ খাবার হলেও রাজনীতি ও প্রতিবাদের মঞ্চে এটি একধরনের প্রতীকী অস্ত্র। অতীতে বহুবার দেখা গেছে, রাজনীতিবিদদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে সাধারণ মানুষ ডিম ছুড়ে মেরেছে।

১৯৬৩ সালে রোমান গভর্নর ভেসপাসিয়ানকে প্রজারা শালগম ছুড়ে মেরেছিল। তবে মধ্যযুগে ডিম যুক্ত হয় এ তালিকায়। সেই সময় বন্দীদের প্রকাশ্যে বেঁধে ডিম ছোড়া ছিল নিয়মিত ঘটনা। এলিজাবেথীয় যুগে নাট্যমঞ্চে খারাপ অভিনয়ের প্রতিবাদে দর্শকরা পচা ডিম ছুড়ত। অনেকে হাঁস বা মুরগির ডিমকে রসিকতা করে ব্যাচেলর ফুড বলেন। অথচ পুষ্টিগুণে ভরপুর এই ডিমকে প্রতিবাদের নামে ছুড়ে মেরে নষ্ট করা হয় অহরহ। ডিম সহজে ফেটে যায়, আঘাত করলে ছোট্ট শব্দ হয় আর ভেতরের রস ছড়িয়ে পড়ে। এতে ছোড়া মানুষ আনন্দ পায়, আর যাকে আঘাত করা হয় তিনি বিব্রত হন।

বাংলাদেশের আদালত চত্বরে ডিম নিক্ষেপের ঘটনা দেখা গেছে। সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে এনসিপি নেতা আক্তার হোসেনের ওপরও ডিম ছোড়া হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন ঘিরে ড. ইউনূস ও তার সরকারের সদস্যদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে নেতাকর্মীরা নিউ ইয়র্কে জড়ো হন। এর আগে জ্যাকসন হাইটসে পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল, সভা, এমনকি হাতাহাতি ও মারামারিও হয়েছে। যেখানে অন্য দেশের মানুষ জাতিসঙ্ঘের সামনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানববন্ধন করেন, সেখানে আমরা হয়ে যাই বিভক্ত। ডিমের শিকার হওয়া আক্তার হোসেন জানিয়েছেন, এতে তিনি ভয় পাননি। যেমন ভয় পাননি শেখ হাসিনার বুলেট-বোমাকে।

ডিম ছোড়ার পাশাপাশি ‘ডিম থেরাপি’ নামে একটি প্রচলনও রয়েছে, যা কিছু দেশে এখনো রোগ সারাতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে অবশ্য এটি রসিকতার সঙ্গে যুক্ত—অনেকে দাবি করেন, রিমান্ডে থাকা আসামিদের কাছ থেকে তথ্য বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ডিম থেরাপি দেয়।

ডিম নিক্ষেপের ইতিহাস বহুকালের। প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে খাবার ছোড়া এসেছে অনেক আগে থেকে। কথিত আছে, মধ্যযুগে বন্দীদের ওপর শাস্তি হিসেবে ডিম মারা হতো। তবে লিখিতভাবে এ ঘটনার উল্লেখ মেলে উনিশ শতকের দিকে। ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের কাছের আয়েল অব ম্যান এলাকায় মেথোডিস্টদের লক্ষ্য করে ডিম ছোড়া হয়েছিল।

বিশ্বজুড়ে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ডিমের শিকার হয়েছেন। হলিউড অভিনেতা আর্নল্ড শোয়ার্জনিগার ২০০৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রচারণা চালানোর সময় ডিমের আঘাত পান, তবে সিনেমার নায়কের মতোই সেটি হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলেন। ২০০৪ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ডিমের আঘাতে হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০১১ সালে আফগান বিক্ষোভকারীরা তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে ইরানি কনস্যুলেটের দিকে ডিম ছোড়েন। ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যে রাজা তৃতীয় চার্লসের ওপর ডিম নিক্ষেপে অভিযুক্ত এক ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এমনকি ১৯১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী বিলি হিউজও জনসভায় ডিমের আঘাত পেয়েছিলেন।

২০০১ সালে ব্রিটিশ উপ-প্রধানমন্ত্রী জন প্রেসকটকে এক তরুণ কৃষক ডিম ছুড়লে, প্রেসকট নিজেই ঘুষি মেরে প্রতিক্রিয়া দেখান। মুহূর্তটির ছবি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার ১৭ বছর বয়সী উইল কনলি ‘এগ বয়’ নামে পরিচিত হন, যখন তিনি বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়া সিনেটর ফ্রেইজার এনিংয়ের মাথায় ডিম ছুড়েন। ভিডিওটি ভাইরাল হয় এবং অনেকে তাকে সমর্থন করে অনুদান দেন। ১৮৩৪ সালে মার্কিন কবি জর্জ হোয়াইট দাসত্ববিরোধী বক্তৃতা দেয়ার সময়ও ডিম নিক্ষেপের শিকার হয়েছিলেন।

বাংলাদেশেও একই চিত্র। কিছুদিন আগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী-নেতাকে বহনকারী প্রিজন ভ্যানে আইনজীবীরা ডিম ছুড়ে মারেন।

খাবার ছুড়ে মারাকে সাধারণত অহিংস প্রতিবাদ ধরা হলেও, যুক্তরাষ্ট্রে এটিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিউ ইয়র্কে এনসিপি নেতাকে ডিম ছোড়ার ঘটনায় যুবলীগের এক কর্মীকে গ্রেপ্তার করে মামলা দেওয়া হয়, পরে জামিনে ছাড়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে যেকোনো বস্তুর আঘাত অপরাধ। এটি যদি ঘৃণা বা খারাপ উদ্দেশ্যে করা হয়, তাহলে শাস্তি আরও কঠোর হতে পারে। আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী, কূটনীতিক বা আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত ব্যক্তির ওপর হামলা করলে প্রতিটি দেশকেই আইনগত ব্যবস্থা নিতে হয়। যদিও বাস্তবে নিউ ইয়র্কে এ ধরনের অপরাধ গুরুতর ধরা হয়নি—সাধারণত মুচলেকা বা প্রবেশন দিয়েই শেষ হয়।

শেষে ডিমের দামের হিসাব। নিউ ইয়র্কে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক ডজন ডিমের দাম ছিল ৮ দশমিক ৫০ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় এক হাজার ৩৪ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি ডিমের দাম প্রায় ৮৬ টাকা। আর বাংলাদেশে এই প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে যাওয়া ডিম এখন কিনতে হয় মাত্র সাড়ে ১২ টাকায়।

আরও দেখুন

মাহফুজ ও আসিফ কি স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন নাকি কোনো দলে যাচ্ছেন

মাহফুজ ও আসিফ কে কোন দলে যাচ্ছেন – এনসিপি নাকি বিএনপি?

আমেরিকা বাংলা ডেস্ক – অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ …