
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো, তার নেতৃত্বে এলেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস। অনেকেই তখন মনে করেছিলেন, দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে আসা একজন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি হয়তো নতুন আশার আলো দেখাতে পারবেন। বিশেষ করে তার আন্তর্জাতিক সুনাম, সামাজিক ব্যবসার ধারণা আর দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইতিহাস মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছিল—তিনি হয়তো এই দেশের জন্য নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ একটা রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা এতটা সহজ ছিল না।
শুরু থেকেই অর্থনৈতিক চাপ যেন এই সরকারের সবচেয়ে বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াল। টাকার মান কমে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, জ্বালানির দাম বাড়া আর বাজারে অস্থিরতা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তোলে। ইউনুস সরকার এসব সমস্যার সমাধানে সুদূরপ্রসারী কোনো নীতি দিতে পারেনি। মানুষ ভেবেছিল তাদের কষ্ট লাঘব হবে, কিন্তু সেই পরিবর্তন আসেনি। বাজারের দাম বাড়তেই থাকল, দুর্নীতির অভিযোগও কমল না। ফলে সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে তার সরকারের প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রেও আশানুরূপ কিছু ঘটেনি। সবাই ভেবেছিল তিনি অন্তত একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের রোডম্যাপ দেখাবেন। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হলো না। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও তার প্রতি আস্থা দেখায়নি। বরং অনেক সময় মনে হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে দুর্বল করে তোলা হচ্ছে। বড় দুই রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ আর বিএনপি—দুটোর কেউই তাকে পূর্ণ সমর্থন দেয়নি। তারা তাকে সফল হতে দিল কি না, সেটি নিয়েই প্রশ্ন থেকে যায়।
এখানে আরেকটি দিকও খেয়াল করতে হয়। প্রশাসনের ভেতরে যে শক্তিশালী আমলাতান্ত্রিক কাঠামো রয়েছে, সেটিও তার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা স্বার্থগোষ্ঠী কোনো বড় পরিবর্তন আসতে দেয়নি। উপরন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপও তাকে স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল অঞ্চল; বড় শক্তিগুলো প্রত্যেকেই চাইছিল নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে। তাই ইউনুস স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে গেলেই নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা এসেছে।
তবে সব দোষ কেবল বাইরের নয়। ইউনুসের নিজস্ব সীমাবদ্ধতাও এখানে স্পষ্ট। তিনি একজন উন্নয়নচিন্তক, একজন স্বপ্নবাজ, কিন্তু রাজনীতির কঠিন বাস্তবতায় কখনো কাজ করেননি। মাঠের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, দলীয় কৌশল কিংবা ক্ষমতার টানাপোড়েনের অভিজ্ঞতা তার ছিল না। ফলে তিনি অনেক সময় বাস্তবতার বদলে আদর্শ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা কার্যকর হয়নি। আবার তার চারপাশে দক্ষ ও অভিজ্ঞ একটি টিম গড়ে উঠেনি, যা হয়তো তাকে সাহায্য করতে পারত।
জনগণের চোখে প্রশ্ন ছিল খুব সাধারণ—তাদের জীবন কি সহজ হলো? নিত্যপণ্যের দাম কি কমল? দুর্নীতি কি কমল? দুঃখজনকভাবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না। তাই জনগণ তাকে ব্যর্থ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। যদিও কিছু মানুষ এখনও বিশ্বাস করে, যদি তাকে সময় ও স্বাধীনতা দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো তিনি কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবে যেটা ঘটেছে, তা হলো তার সরকার যেমন নিজস্ব সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, প্রশাসনিক বাধা আর আন্তর্জাতিক স্বার্থের জালে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবেও ব্যর্থ করে তোলা হয়েছে।
অতএব বলা যায়, ইউনুস সরকার কেবল ব্যর্থ নয়, বরং ব্যর্থ করে দেওয়ারও শিকার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্দলীয় একজন উন্নয়নকর্মী দিয়ে সংকট সমাধানের স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এই অভিজ্ঞতা আমাদের স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দেয়, দক্ষ প্রশাসন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর জনআস্থা ছাড়া কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার টেকসই সমাধান দিতে পারে না।