গাজায় ইতালির ফ্লটিলা কি আদৌ পৌঁছাবে?

গাজায় ইতালির ফ্লটিলা কি আদৌ পৌঁছাবে?
গাজায় ইতালির ফ্লটিলা কি আদৌ পৌঁছাবে?

মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ইতালির মানবিক সাহায্যবাহী ফ্লটিলা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে। গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষদের খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণার পর থেকেই এই ফ্লটিলা যেন এক রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে উঠেছে। প্রশ্নটা এখন আর শুধু সাহায্য পৌঁছাবে কি না, বরং এটি আন্তর্জাতিক আইন, সমুদ্রপথের নিরাপত্তা, ইসরায়েলের অবরোধনীতি এবং বৈশ্বিক মানবিক কূটনীতির এক বড় পরীক্ষার কাহিনি। আর তাই সবার মনে একটাই প্রশ্ন—ইতালির এই ফ্লটিলা আসলেই গাজায় পৌঁছাতে পারবে তো?

গাজার ওপর ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের অবরোধ নতুন কিছু নয়। ২০০৭ সালে হামাস ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সমুদ্র ও স্থলপথে কঠোর নিয়ন্ত্রণ চালু রয়েছে। কোনো দেশ থেকে মানবিক সহায়তা আসলেও তা ইসরায়েলের অনুমতি ছাড়া ঢুকতে পারে না। এর আগেও ২০১০ সালে “গাজা ফ্লটিলা” বহুল আলোচিত হয়ে উঠেছিল, যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন কর্মীকে হত্যা করেছিল। সেই স্মৃতি এখনও বিশ্বের মানবাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে তীব্র ক্ষত হিসেবে রয়ে গেছে। ফলে আজকের এই ইতালিয়ান ফ্লটিলা স্বাভাবিকভাবেই সেই অতীতের প্রতিচ্ছবি মনে করিয়ে দেয়।

ইতালি কেন এমন ঝুঁকি নিচ্ছে, সেটিও আলোচনার বিষয়। একদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতর থেকেই গাজার যুদ্ধ ও মানবিক সংকট নিয়ে নানা বিভাজন রয়েছে। অনেক রাষ্ট্র প্রকাশ্যে ইসরায়েলের প্রতি নরম, আবার অনেকেই ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে থাকার কথা বলছে। ইতালি যদি সফলভাবে এই ফ্লটিলা গাজায় পৌঁছে দিতে পারে, তাহলে তা শুধু মানবিক সাহায্য নয়, ইউরোপে একটি শক্ত রাজনৈতিক বার্তাও পৌঁছে দেবে—যে ইউরোপের অন্তত কিছু অংশ ফিলিস্তিনিদের দুঃখকষ্টকে গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নিতে সাহস দেখাচ্ছে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসরায়েলের অবস্থান খুব কঠোর। তারা সমুদ্রপথে কোনো “অবাধ প্রবেশ” মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। প্রতিটি জাহাজই তাদের চোখে সম্ভাব্য হুমকি, কারণ এর আড়ালে অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম ঢুকে যেতে পারে বলে তারা দাবি করে। ইসরায়েল ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করেছে, আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা থেকে শুরু করেই তারা ফ্লটিলাকে আটকে দেওয়ার অধিকার প্রয়োগ করবে। এর মানে দাঁড়ায়, ফ্লটিলা যতই মানবিক উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করুক, তার যাত্রাপথে যে কোনো মুহূর্তে সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কি ফ্লটিলা গাজায় পৌঁছানো একেবারেই অসম্ভব? আসলে এখানে কয়েকটি ভিন্ন চিত্র তৈরি হতে পারে। যদি আন্তর্জাতিক চাপ যথেষ্ট বাড়ে, বিশেষ করে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ফ্লটিলার নিরাপদ যাত্রাকে সমর্থন জানায়, তবে ইসরায়েলের জন্য তা একতরফাভাবে আটকানো কঠিন হয়ে পড়বে। কিন্তু যদি বড় শক্তিগুলো নীরব থাকে, তাহলে ইসরায়েল স্বাভাবিকভাবেই আগের মতো শক্ত অবস্থান নেবে। ফলে ফ্লটিলাকে হয়তো পথেই থামিয়ে দেওয়া হবে, জাহাজগুলোকে অন্য বন্দরে সরিয়ে নিতে বাধ্য করা হবে, কিংবা আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় টেনে নিয়ে যাওয়া হবে।

মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফ্লটিলার যাত্রা যেমন সহানুভূতির প্রতীক, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি আবার এক প্রকার শক্তির খেলা। ইতালি যদি এ যাত্রায় সফল হয়, তবে তারা ফিলিস্তিনি ইস্যুতে নতুন করে একধরনের নেতৃত্ব দাবি করতে পারবে। কিন্তু যদি ব্যর্থ হয়, তবে সেটি শুধু একটি মানবিক উদ্যোগের পরাজয় নয়, বরং প্রমাণ হবে যে আন্তর্জাতিক কূটনীতি এখনও ইসরায়েলের সামরিক নীতির সামনে অসহায়। এ ক্ষেত্রে ফ্লটিলা একরকম দ্বৈত প্রতীকে পরিণত হয়েছে—একদিকে আশার আলো, অন্যদিকে সম্ভাব্য ব্যর্থতার আশঙ্কা।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, গাজার মানুষ আজ তীব্র মানবিক সংকটে আছে। খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম—সবকিছুই প্রায় অপ্রতুল। এই অবস্থায় ফ্লটিলা শুধু একটি জাহাজ নয়, গাজার মানুষের কাছে এটি বাঁচার সম্ভাবনা। তারা জানে হয়তো এই উদ্যোগও আটকানো হবে, তবুও প্রতিটি সাহায্যের প্রচেষ্টা তাদের কাছে আশা জাগায়। কারণ প্রতিবারই যখন কোনো দেশ বা সংগঠন সাহস করে গাজার পথে পা বাড়ায়, তখনই বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে তাদের দুর্দশা।

অতএব প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। ফ্লটিলা গাজায় পৌঁছাতে পারবে কি না, তা নির্ভর করছে অনেকগুলো বিষয়ে—আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ, ইসরায়েলের সামরিক প্রস্তুতি, আর ইউরোপীয় দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থান। ইতিহাস বলছে, এ ধরনের যাত্রা সচরাচর শেষ পর্যন্ত সফল হয় না। তবে এটাও সত্যি, প্রতিবারের প্রচেষ্টা ইসরায়েলি অবরোধের বাস্তবতাকে নতুন করে বিশ্ববাসীর চোখের সামনে তুলে ধরে। তাই বলা যায়, ফ্লটিলা হয়তো গাজায় পৌঁছাবে না, কিন্তু এটি পৌঁছে যাবে বৈশ্বিক জনমনে, পৌঁছে যাবে আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে।

আরও দেখুন

ট্রাম্পের পরিকল্পনা কতটা শান্তি আনবে

ট্রাম্পের পরিকল্পনা শান্তি আনবে নাকি প্রহসন?

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনার জন্য ২১ দফা একটি পরিকল্পনা দিয়েছেন। এর মূল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *