এজেন্ট ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে স্টুডেন্ট ভিসা—বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া!

স্টুডেন্ট ভিসা

নুরুল্লাহ সাঈদ । আটলান্টা জর্জিয়া: বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়া অনেকের কাছে স্বপ্ন মনে হয় কিন্তু প্রক্রিয়াটা একটু জটিল হওয়ায় অনেকে ভাবেন নিজে এপলাই করা মনে হয় সম্বব না। কিন্তু এই ফিচারটা পড়ে সঠিকভাবে ধাপগুলো অনুসরণ করলে আপনি নিজেই সব কিছু করতে পারবেন । বিশেষ করে বাংলাদেশি ছাত্রদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সিলেকশন, ফান্ডিং প্রমাণ, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, স্পনসরের আয় ইত্যাদি জায়গায় ছোট ভুলও ভিসা রিস্ক বাড়িয়ে দেয়। তাই চলুন একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধাপে ধাপে দেখে নেই—কীভাবে বাংলাদেশ থেকে U.S. Student Visa (F-1) এর জন্য আবেদন করবেন।

ধাপ ১: বিশ্ববিদ্যালয় সিলেক্ট করা এবং বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে ভাবনা – প্রথম কাজ হলো ৩ থেকে ৫টি ভালো বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেওয়া, যেগুলো আন্তর্জাতিক ছাত্রদের I-20 ইস্যু করে। বাংলাদেশের ছাত্রদের জন্য এখানে কয়েকটা বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি—

যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আপনি আবেদন করছেন, সেখানে আপনার রেজাল্ট, IELTS/TOEFL/DUOLINGO বা GRE/GMAT স্কোর বাস্তবসম্মতভাবে মানানসই কি না, সেটা আগে যাচাই করবেন। অনেকেই শুধু “নাম শুনে” হাই-প্রোফাইল ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করেন, পরে অ্যাডমিশন না পেলে সময় নষ্ট হয়। আপনি নির্বাচিত ৩–৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ভর্তি আবেদন করবেন। আবেদন গ্রহণ হলে তারা প্রথমে আপনার একাডেমিক ডকুমেন্ট, পরে আর্থিক ডকুমেন্ট—যেমন ব্যাংক স্টেটমেন্ট, স্পনসরের আয়ের প্রমাণ—চেয়ে পাঠাবে।

ধাপ ২: I-20 ফর্ম সংগ্রহ করা – আপনার ভর্তি আবেদন ও আর্থিক ডকুমেন্ট যাচাই করে বিশ্ববিদ্যালয় যদি আপনাকে “admit” করে, তখন তারা আপনাকে I-20 ফরম পাঠাবে। এই I-20 তে থাকে—আপনার নাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, কোর্স, প্রোগ্রামের সময়কাল, মোট খরচ, অনুমানকৃত স্কলারশিপ (থাকলে) এবং কে খরচ বহন করবে তার তথ্য। এই ফরমটি ভালো করে দেখে নামের বানান, জন্মতারিখ ও প্রোগ্রামের তথ্য ঠিক আছে কি না মিলিয়ে নিন। কোনো ভুল দেখলে সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করে সংশোধন করে নেবেন। কারণ এই I-20 হচ্ছে আপনার ভিসা প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি—এটা ছাড়া ভিসার পরবর্তী কোনো ধাপে যাওয়া যাবে না।

ধাপ ৩: SEVIS I-901 ফি পরিশোধ – I-20 পাওয়ার পর বাংলাদেশের যে কোনো ছাত্রকে অনলাইনে SEVIS I-901 ফি পরিশোধ করতে হয়। সাধারণত এটি ৩৫০ ডলার ধরে নেওয়া হয় (বর্তমান রেট অনুযায়ী দেখে নেবেন)। https://sevp.ice.gov ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনার SEVIS নম্বর (I-20 তে থাকে) দিয়ে রেজিস্টার করে অনলাইনে ফি পরিশোধ করবেন। পেমেন্ট সফল হলে একটি কনফার্মেশন পেজ/রসিদ পাবেন—এটি অবশ্যই প্রিন্ট করে রাখবেন, কারণ ঢাকায় ভিসা সাক্ষাৎকারের সময় এটি দেখাতে হতে পারে।

ধাপ ৪: DS-160 ভিসা ফরম পূরণ – এবার অনলাইনে DS-160 ফরম পূরণ করতে হবে। এটি হচ্ছে আপনার নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসা আবেদন ফরম। এখানে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য, বাংলাদেশে আপনার ঠিকানা, পরিবারের তথ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা, যুক্তরাষ্ট্রে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, কতদিন থাকবেন, আর্থিক সোর্স কী—সবকিছু বিস্তারিতভাবে দিতে হয়। বাংলাদেশি ছাত্রদের জন্য এখানে খুব সতর্ক থাকার বিষয় হলো—

আপনার সমস্ত তথ্য যেন পাসপোর্ট, I-20 এবং অন্যান্য ডকুমেন্টের সাথে মিল থাকে – DS-160 পূরণ শেষে আপনি একটি কনফার্মেশন পেজ পাবেন, যেখানে বারকোড থাকবে। এই কনফার্মেশন পেজটি প্রিন্ট করে ভিসা ইন্টারভিউতে সঙ্গে নিতে হবে।

ধাপ ৫: ভিসা ফি পরিশোধ ও ঢাকায় সাক্ষাৎকারের তারিখ নেওয়া – DS-160 সম্পন্ন করার পর U.S. Travel Docs ওয়েবসাইটে গিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। সেখান থেকে আপনি ভিসা ফি (সাধারণত ১৮৫ ডলার) পরিশোধ করবেন। ফি পেমেন্টের পর সেই একই প্ল্যাটফর্ম থেকে আপনি ঢাকায় অবস্থিত U.S. Embassy-তে ভিসা সাক্ষাৎকারের তারিখ বুক করতে পারবেন। বাংলাদেশি ছাত্রদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ টিপস হলো—

  • ভিসা ইন্টারভিউ তারিখ নিতে দেরি না করা, কারণ গ্রীষ্ম বা ফাল সেমিস্টারের আগে সাধারণত অ্যাপয়েন্টমেন্ট খুব দ্রুত ফিল আপ হয়ে যায়।
  • I-20 তে দেওয়া প্রোগ্রাম শুরুর তারিখের অনেক আগে ইন্টারভিউ শিডিউল রাখার চেষ্টা করবেন, যাতে ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্য সময় হাতে থাকে।

ধাপ ৬: সব ডকুমেন্ট প্রস্তুত করা (বাংলাদেশি রিয়েলিটি মাথায় রেখে) – সাক্ষাৎকারের আগে সব ডকুমেন্ট গোছানো খুব জরুরি। সাধারণত যে কাগজগুলো সঙ্গে রাখতে হবে—

  • বৈধ পাসপোর্ট
  • I-20 (সাইন করা)
  • DS-160 কনফার্মেশন পেজ
  • SEVIS I-901 ফি রসিদ
  • ভিসা ফি পেমেন্টের প্রমাণ (যদি প্রযোজ্য হয়)
  • শিক্ষাগত সনদ ও মার্কশিট (SSC, HSC, Bachelor ইত্যাদি)
  • IELTS/TOEFL/অন্যান্য টেস্ট স্কোর রিপোর্ট
  • ব্যাংক স্টেটমেন্ট (সাম্প্রতিক, পরিষ্কারভাবে দেখায় যে আপনার টিউশন + লিভিং খরচ কাভার করা সম্ভব)
  • স্পনসরের আয়ের কাগজপত্র—salary certificate, tax papers, ব্যবসার কাগজ, rental income প্রমাণ ইত্যাদি

বাংলাদেশি ছাত্রদের ক্ষেত্রে অনেক সময় একাধিক স্পনসর থাকে (বাবা, মা, চাচা ইত্যাদি)। সেক্ষেত্রে সম্পর্কের প্রমাণ (জন্মসনদ, এফিডেভিট ইত্যাদি) থাকলে ভালো হয়। সব ডকুমেন্ট একটি সাধারণ কিন্তু সাজানো ফোল্ডারে রেখে এমনভাবে গুছিয়ে রাখুন, যেন অফিসার চাইলে সাথে সাথেই দেখাতে পারেন।

ধাপ ৭: সাক্ষাৎকারের দিন—বাংলাদেশি ছাত্রদের সাধারণ প্রশ্ন ও করণীয় – সাক্ষাৎকারের দিন ঢাকার U.S. Embassy-তে নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে যান। লম্বা লাইন ও সিকিউরিটি চেক ধরেই বের হন। ইন্টারভিউতে ভিসা অফিসার সাধারণত কিছু স্ট্যান্ডার্ড প্রশ্ন করেন—

  • কেন এই নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করেছেন?
  • আরও কোথায় আবেদন করেছিলেন, কয়টায় ভর্তি পেয়েছেন?
  • পড়াশোনার সব খরচ কে বহন করবে, এবং কীভাবে?
  • বাংলাদেশে আপনার পারিবারিক ও আর্থিক বন্ধন কী কী (family ties)?
  • পড়াশোনা শেষ করে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী—বাংলাদেশে ফিরে কী করবেন?

এখানে মূল কথা—উত্তর যেন সংক্ষিপ্ত, পরিষ্কার, আত্মবিশ্বাসী এবং সত্য হয়। অতিরিক্ত মুখস্থ করা বা বানানো গল্প বললে অপ্রাকৃতিক লাগে, যা অফিসার সহজেই বুঝতে পারেন। আপনি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট থেকে যদি দেখাতে পারেন যে আপনার পরিবার এখানে প্রতিষ্ঠিত, ভবিষ্যত পরিকল্পনা আছে এবং আপনি স্টুডেন্ট ভিসাকে ইমিগ্রেশন ভিসার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছেন না—তাহলে ভিসা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

ধাপ ৮: ভিসা অনুমোদন, পাসপোর্ট রিসিভ ও ফ্লাইট প্ল্যান – ভিসা অনুমোদিত হলে অফিসার সাধারণত আপনাকে জানিয়ে দেন, এবং আপনার পাসপোর্ট কয়েক দিনের মধ্যে কুরিয়ার/পিকআপ পয়েন্টের মাধ্যমে ফেরত পাবেন। পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার পর ভিসার মেয়াদ, নামের বানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য সব ঠিক আছে কি না ভালো করে দেখে নেবেন।

I-20 তে উল্লেখিত প্রোগ্রাম শুরুর তারিখের ৩০ দিন আগে পর্যন্ত আপনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন। উদাহরণ হিসেবে, যদি আপনার ক্লাস শুরু ১ সেপ্টেম্বর, তবে আপনি সর্বোচ্চ ২ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারবেন। এই হিসাব ধরে ফ্লাইট বুক করুন, নতুন জায়গায় পৌঁছে বাসার ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টেশন ইত্যাদিতে অংশ নেওয়ার জন্য কয়েকদিন অতিরিক্ত সময় রাখলে ভালো হয়।

ধাপ ৯: ভ্রমণের দিন—বাংলাদেশি ছাত্রদের জন্য শেষ মুহূর্তের চেকলিস্ট – যেদিন আপনার ফ্লাইট, সেদিন বাসা থেকে বের হওয়ার আগে একবার ভালোভাবে চেক করে নিন—

  • পাসপোর্ট
  • I-20 (হ্যান্ড লাগেজে রাখবেন)
  • ভিসা অনুমোদনের কাগজপত্র (যদি কিছু থাকে)
  • SEVIS ও ভিসা ফি রসিদ (প্রিন্ট কপি)
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার ও কনট্যাক্ট ডিটেল
  • জরুরি কিছু টাকার ব্যবস্থা (ক্যাশ ও কার্ড দুইভাবেই)

এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন অফিসারও কখনও কখনও I-20 বা প্রশ্ন করতে পারে, তাই সবকিছু হাতের কাছে রাখুন। সব ঠিক থাকলে আপনি নিশ্চিন্ত মনে যুক্তরাষ্ট্রের পথে রওনা দিতে পারবেন।

শেষ কথা (বিশেষ করে বাংলাদেশের ছাত্রদের জন্য) – বাংলাদেশ থেকে U.S. Student Visa পাওয়ার পুরো প্রক্রিয়া আসলে একটি পরিকল্পিত প্রজেক্টের মতো। বিশ্ববিদ্যালয় সিলেকশন থেকে শুরু করে ব্যাংক স্টেটমেন্ট, DS-160, SEVIS ফি, ইন্টারভিউ—প্রতিটি ধাপে আপনি যত বেশি প্রস্তুত, তথ্য যত পরিষ্কার, আর উত্তর যত আত্মবিশ্বাসী হবে, আপনার সফলতার সুযোগও তত বেশি হবে।

আপনি যদি এই স্টেপ-বাই-স্টেপ গাইডটি অনুসরণ করেন, তাহলে একা নিজেও সহজে পুরো প্রক্রিয়া সামলাতে পারবেন—এটাই এই গাইডের উদ্দেশ্য।

আরও দেখুন

জেলেনস্কি বললেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা কঠিন হলেও ফলপ্রসূ

“যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা কঠিন হলেও ফলপ্রসূ”-জেলেনস্কি

মুহাম্মদ সোহেল রানাঃ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চলমান প্রসঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান …